প্রেমে ব্রেকআপের পর নিজেকে গুছিয়ে নিতে
কখনো কখনো নির্দিষ্ট কোনো মানুষের কাছে গেলে মনে হয়, আশ্চর্য কোনো জলের কাছে এসেছি। ওই মানুষটিও জানে, একা একটি মানুষ বহু বাধা ডিঙিয়ে সঙ্গ দিতে নিঃসঙ্গ জলের খোঁজে এসেছে। যে জলের কাছে গেলে তেষ্টা উবে যায়, একলা মানুষের ব্যথা যৌথ হয়ে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। এরই নাম হয়তো প্রেম, যা দুটি একা মানুষ একে অপরকে আর নিঃসঙ্গ হতে দেয় না। কিন্তু প্রেমের সঙ্গে বিচ্ছেদের সম্পর্ক তো শীতের রোদের সঙ্গে ঘন কুয়াশার মতো। একদিন বিচ্ছেদ এসে সব এলোমেলো করে দেবে রোদ।
যেমনটা হিরণের (ছদ্মনাম) ক্ষেত্রে ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার শুরুর দিকে ক্যাম্পাসের রোদ পেরিয়ে তাঁর কাঁধ ছুঁয়ে আশ্রয় নিয়েছে অন্য কারও নিশ্বাস। ওই নিশ্বাস মিতালীর (ছদ্মনাম)। তত দিনে জেনে গেছে, কাঁধের ওপর কারও নিশ্বাসের আশ্রয় মানে প্রেম। সে সময় ক্যাম্পাসের সব রঙিন আলো চুনি হয়ে চোখে আর সব সবুজ পান্না হয়ে ঢুকে গেল দুজনের মনের ভেতর। তিরতির করে বয়ে চলা নদীর জল, জলের ওপর হুমড়ি খাওয়া গাছের ছায়া-মেঘ, ভোরের কুয়াশা, আর হাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে হারিয়ে ফেলা পথ—সবই তখন হিরণের মন মিতালীর মনের ভেতর পৌঁছানোর সেতু হয়ে উঠল।
এই সেতু পেরোতে পেরোতেই দুজনে হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিলেন, স্বপ্নেও আমরা একই পথে হাঁটব। প্রেম যদি চায়, তাহলে একসঙ্গেই উচ্ছন্নে যাব। ব্যস, শুরু হয়ে গেল দুজনের তুমুল প্রেমের দিন। প্রেম তো মনপড়া জানে। তাই একজনের ব্যথায় আরেকজনের বুক ঝিম হয়ে থাকে। শুধু দেখা হবে বলে দীর্ঘক্ষণ তাঁদের মন বসে থাকে। একটু দেরি হলেই, কোথায় যেন বৃষ্টি নামে জোরে। অথচ সেই বৃষ্টির ভেতর এখন জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে আছেন হিরণ।
সম্পর্কের চার বছরের মাথায় দুজনের পথ দুই দিকে গেছে বেঁকে। হিরণ আগেই কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ, মিতালী অনেকটা এড়িয়ে চলা শুরু করেছিলেন। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে হিরণকে সাফ জানিয়ে দেন, এই সম্পর্ক আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কেন? এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রশ্নহীন এই উত্তরে বুকের ভেতর মেঘ ভেঙে পড়ে হিরণের। হু হু করে ওঠে মন। তাহলে কার সঙ্গে আর উচ্ছন্নে যাব—এই ভাবনায় উথালপাতাল হাওয়া ঢুকে ফাঁকা করে দেয় বুকের ভেতর। ক্যাম্পাস খোলার আগেই খবর আসে, চলতি সপ্তাহেই বেজে উঠছে প্রেমিকা, মানে মিতালীর বিবাহবাঁশরি।
এই খবরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় হিরণের। জীবন বড় আশ্চর্য জায়গায় এসে থেমে যায় তাঁর। যেন কোথাও আর এক পা এগোনোর নেই। ক্যাম্পাস খুলেছে। তবু কিছুতেই মন নেই তাঁর। যেখানেই যান থম মেরে বসে থাকেন। যেন উঠে দাঁড়ালেই মন শূন্য হয়ে ধপ করে পড়ে যাবে সন্ধ্যার গভীরে। যৌথভাবে চেয়েও নিঃসঙ্গ হয়ে তাঁর পথ চলে গেছে উচ্ছন্নের দিকে। অতঃপর একদিন বিচ্ছেদের দূরত্ব অতিক্রম করে ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনেও। কীভাবে? এই উত্তর হিরণের কাছেই শুনি।
‘শুরুতে মনে হয়েছিল, মিতালীকে ছাড়া এ জীবন অর্থহীন। বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েও ফিরে এসেছি। মনোচিকিৎসকের কাছে কাউন্সেলিং নিতে হয়েছে বেশ। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বাড়িয়ে দিই। ওই আড্ডাতেই শিখেছি, মানুষ শুধু বয়সে বড় হয় না; বড় হয় আঘাতে আঘাতে। শিখেছি, একজীবনে অনেকগুলো জানালা থাকে। একটা বন্ধ হয়ে গেলে আরেকটা খুলে যায়, হাওয়া দেয়; অন্য প্রেমের মতো। সেসব এখন ভেবেচিন্তে দেখে জীবনকে নতুনভাবে গুছিয়ে নিচ্ছি’, এভাবেই বিচ্ছেদ-ব্যথা পেরিয়ে আসার গল্প বলেছেন হিরণ।
দ্য গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সাইকোথেরাপিস্ট ফিলিপা পেরি সম্পর্কের বিচ্ছেদকে শেখার অভিজ্ঞতা হিসেবে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে আপনি একই ধরনের আচরণে পরবর্তী সম্পর্কের দিকে যেতে না পারেন।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতটা কাছাকাছি আছি, তা বোঝার জন্য কখনো কখনো নিজে থেকেই দূরে সরে যেতে হয়। এটা বুঝতে পেরেছিলেন আশফি (ছদ্মনাম)। তৌফিকের (ছদ্মনাম) সঙ্গে তাঁর প্রায় তিন বছর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একদিন আশফি বুঝতে পারেন, তৌফিক সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ অন্যমনস্ক। এমন অন্যমনস্কতায় হাত থেকে ফসকে পড়া কাচের গ্লাসের মতো হৃদয়ও ভেঙে যায়। আশফি সিদ্ধান্ত নেন, আর নয়, এবার একা থাকা শিখবেন। নিজেকে সময় দেবেন।
আশফি বলেন, ‘প্রেম তো একসময় অভ্যাস হয়ে যায়। তাই বিচ্ছেদের পর বিষয়টা থেকে মানসিকভাবে বেরিয়ে আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। নিজেকে সময় দিয়েছি। আবার বিচ্ছেদের ভয়ে নতুন কোনো সম্পর্কে জড়াইনি। লক্ষ্য নির্ধারণ করে অবিচল থেকেছি। অস্ট্রেলিয়ায় একটি স্কলারশিপ পেয়েছি। মাস দুয়েকের মধ্যেই চলে যাব। বিচ্ছেদ না হলে হয়তো এটা সম্ভব হতো না। জীবনে প্রেম ও বিচ্ছেদ—দুটিই মানুষকে শিক্ষা দেয়।’
আশফি যে পদ্ধতিতে বিচ্ছেদের দূরত্ব অতিক্রম করেছেন, সে একই পদ্ধতির কথা বলেছেন ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির চার্টার্ড ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট লিন্ডা ব্লেয়ার। তিনি বলেছেন, একা থাকা নতুন দক্ষতা শেখার সুযোগ হতে পারে। খারাপ সম্পর্কের চেয়ে একা থাকা ভালো।
আর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আহমেদ হেলাল বলেছেন, সম্পর্ক হওয়াটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি বিচ্ছেদও একটি স্বাভাবিক বিষয়। সম্পর্ক টক্সিক হয়ে উঠলে বিচ্ছেদ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নিজে চাপমুক্ত হওয়ার জন্য ওই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাই ভালো। সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দুজনেরই সমান। তাই অন্যের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে হবে। এতে সাময়িক কষ্ট হবে, তবে নিজের ক্ষতি করা যাবে না। এ জন্য সামাজিক কাজ ও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আর নতুন করে কোনো সম্পর্কে জড়ানোর সুযোগ থাকলে সেই সুযোগ নেওয়াই ভালো।
বিচ্ছেদের বিপরীতে আসলে নিজের জীবনকে ভালোবাসতে হয়। যারা মাঝপথে ছেড়ে যায় দূরে, যারা আর ফিরবে না কোনো দিন, তাদের থেকে বহুদূরে ফুল হয়ে ফুটে থাকতে হয়। পুরোনো কষ্ট যেভাবে ফুটে থাকে শীতের সকালে। হারানো দিনের মতো শীত-সন্ধ্যা, উথালপাতাল হাওয়া তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে হয় প্রতিদিন জোড়া শালিক দেখার ছলে।