আপনার শো অফ অন্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে না তো
শামসুন নাহার একজন গৃহিণী। স্বামী সাধারণ বেসরকারি চাকরিজীবী। এত অর্থবিত্ত না থাকলেও তাঁদের দিন ভালোভাবেই চলে যায়। হঠাৎ একদিন শামসুন নাহার যুক্ত হন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি ঘর সাজানোর গ্রুপে। ওই গ্রুপের অন্য সদস্যদের মতো করে তাঁরও সাজাতে ইচ্ছা করে ঘর। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিয়ে হলেও তিনি খুঁজে খুঁজে কিনতে শুরু করেন নানা কিছু। দেখা গেল, কোনো মাসে রান্নাঘরে বড় মাছ ঢোকে না, কিন্তু ড্রয়িংরুমে যোগ হয় টেবিল ল্যাম্প কিংবা সেন্টারে টেবিলে বসে ইকেবানার ঝাড়। সংসারে বাড়তি খরচ অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়ে আর তাতে হিমশিম খেতে থাকেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি। ফলাফল, ঝগড়া, মনের মতো কিছু কিনতে না পারলে শামসুন নাহারের অভিমান আর মা–বাবার পরিবর্তিত সম্পর্কে দিশাহারা দুই সন্তান।
আরেকজনের কথা বলি, ইফতেখার দীপ্র। প্রযুক্তিপণ্যে তাঁর ভীষণ আগ্রহ। একটি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে যা বেতন পান, তার মূল অংশই ব্যয় হয় নতুন নতুন গ্যাজেট, মুঠোফোন কিংবা স্মার্ট ওয়াচের পেছনে।
অফিসের কোনো সহকর্মী নতুন গ্যাজেট কিনলে তা–ও দীপ্রর কেনা চাই। ফলে দেখা যায়, প্রতি মাস শেষে তাঁকে ধার করে চলতে হয়। কিন্তু নিত্যনতুন ফোন বা গ্যাজেট তাঁর লাগবেই। কথায় কথায় একদিন বলছিলেন, হাতে নতুন মুঠোফোন বা স্মার্ট ওয়াচ না থাকলে নিজেকে মনে হয় ব্যাকডেটেড।
অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে বাস করেন সোহেলী সুলতানা। চলাফেরায় ভীষণ টিপটপ। অফিস বা বাড়ি যেখানেই হোক, পোশাকে অনুষঙ্গে সবার মধ্যমণি হয়ে থাকতে চান। সে জন্য খরচও করেন দেদার। সেরা পোশাকটি পরেন, বাড়িতে চায়ের আড্ডায় সেরা খাবারটি পরিবেশন করেন। সব সময় খেয়াল রাখেন, নিজের গণ্ডির ভেতর তাঁর চেয়ে সেরা যেন কেউ হয়ে না ওঠেন।
আর এতে একধরনের অলিখিত চাপে পড়ে যান সোহেলীর সহকর্মী কিংবা স্বজনেরা। কারণ, সোহেলীর নির্ধারণ করে দেওয়া মানদণ্ডে তাঁদেরও চলতে হয়। দাওয়াতে সোহেলীর চেয়ে বেশি কিছু করতে না পারলেও অন্তত সমান সমান করাটাও অনেকের জন্য বোঝা হয়ে যায়। তবু করতে হয়।
একজনের শো অফের চাপে পড়ে অন্যজনের জীবনে বিভীষিকা নেমে আসার এমন অনেক গল্পই আমরা চারপাশে পাই। চাচাতো বোনের ছেলে যে স্কুলে, সেটাতেই নিজের ছেলেকে ভর্তি করানো, সামর্থ্য না থাকলেও ভাবির মতো শাড়ি কেনা, বন্ধুরা সব গাড়ি কিনে ফেলছে বলে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে হলেও গাড়ি কেনা কিংবা ফেসবুকে অন্যদের ছবি দেখে সিলেটের বদলে দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়া এখন খুব সাধারণ ঘটনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাসরিন আক্তার বলেন, বেশির ভাগ মানুষই একধরনের হীনম্মন্যতা থেকে রক্ষা পেতে নিজের ডিফেন্স মেকানিজমের (প্রতিরক্ষাব্যবস্থা) অংশ হিসেবে শো অফ (লোক দেখানো কাজ) করে। যার ভেতরে কোনো কিছুর অভাব আছে, নিজের সেই দুর্বলতাটুকু ঢাকতে সে অন্য কিছু নিয়ে শো অফ করে। নিজের হীনম্মন্যতা থেকে রক্ষা পেতে সে অন্যকে ছোট করে হলেও বড় হতে চায়। তার বড় হওয়ার এই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যদি লোভ যুক্ত হয়, তখন শো অফ করার প্রবণতাও বেড়ে যায়। তখন শো অফ করাটাই হয়ে দাঁড়ায় তার স্বভাব।
এই যে অন্যের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার তাড়না, লোকে কী বলবে, সেটা ভেবে জীবন যাপনের পদ্ধতি ঠিক করা, এটা কিন্তু বেশি দিন টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না। এমন করতে করতে একদিন দেখা যাবে, নিজের স্বকীয়তাটুকুই হারিয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি আসলে কেমন, সেটা নিজেই ভুলতে বসবেন।
অন্যকে দেখে ঘর সাজাতে, পোশাক পরতে, গ্যাজেট কিনতে চাওয়ার যে ইচ্ছা, তাকে পুঁজিবাদের মূল কথার সঙ্গে যুক্ত করেন নাসরিন আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমরা শো অফ করতে করতে নিজেদের হারিয়ে ফেলি। বুঝতেই পারি না যে কী করছি। দিন শেষে নিজের বলে কিছু থাকে না। কেন এসব করছি, বোঝার চেষ্টা করি না। সব সময় কে কী বলবে, সেটা ভাবি, অন্যকে খুশি করতে গিয়ে শো অফ করতে শুরু করি।’
শো অফ করতে গিয়ে মানুষ অন্যের নয়, বরং নিজেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে বলে মনে করেন মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ ড. মেখলা সরকার। কারণ, অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমরা এমন সব পদ্ধতি অবলম্বন করি, যা আদতে মিথ্যা। হয়তো শো অফের মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো যায়, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বরং গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। কারণ, নিজের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়।
মূলত আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে থাকা মানুষই বেশি শো অফ করে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। শো অফের কারণে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে, পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, বিশ্বাসযোগ্যতাও কমে যায়। নিজের প্রতি সে আস্থা হারিয়ে ফেলে। একসময় নিজেকেই সে আর চিনতে পারে না।
ভার্চ্যুয়াল জগতে নিজেকে শো অফ করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কারণ, এখানে সহজেই অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, একসঙ্গে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। আর এখানেই তৈরি হয় বস্তুগত প্রয়োজন। জীবন অতিমাত্রায় বস্তুবাদী হয়ে ওঠায় জীবনের নির্যাসটুকু নষ্ট হয়ে যায়।
কেউ হয়তো ফেসবুকে ছবি দেওয়ার জন্য বা অন্যকে দেখানোর জন্য ঘরবাড়ি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল, নিজের সামর্থ্য না থাকলেও ধারদেনা করে দেশের বাইরে ঘুরতে গেল বা ব্যয়বহুল কোনো স্কুলে সন্তানকে পড়াল। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তার ওপর যে বাড়তি চাপটুকু পড়ল, সেটা হয়তো সে তখন নিতে পারে না। ফলে শো অফের চক্করে পড়ে তার মানসিক শান্তি নষ্ট হয়, অবসাদে ভুগতে থাকে, সে হয়তো নিজেকেই হারিয়ে ফেলে।
শো অফ করার প্রবণতা দীর্ঘ মেয়াদে কারও জন্যই ভালো হয় না বলে মনে করেন এই মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে, ‘আমরা নিজে যা নই, তা দেখাতে যাওয়ার চেষ্টা করা ভুল। অন্যের চোখে নিজেকে দেখতে গেলে আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে, যা একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।’