স্টেক বানানোর গোপন সূত্র

স্টেক আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত নতুন খাবারছবি: প্রথম আলো

ঝলসানো মাংসের গল্প বলি আজ।

বিশেষ অনুষ্ঠানে অথবা রেস্টুরেন্ট বাদে বাসায় মাংস ঝলসে খাওয়ার চল আমাদের ছিল না কিছুদিন আগেও। আমাদের এখানে কেন, সেই মার্কিন মুলুক যেখানে প্রায় সব বাড়িতেই মাংস ঝলসানোর বারবিকিউ গ্রিল মেশিন আছে, যেখানে গ্রীষ্ম এলেই ঝলসানো মাংসের পার্টি চলে প্রতিটা বাড়ির উঠানে, তারাই এটা শুরু করেছে মাত্র ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে।

আমেরিকায় ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে স্টেক খাওয়ার প্রচলন হয়
ছবি: উইকিপিডিয়া

আমরা কিন্তু এখন বেশ শিখে নিয়েছি, কথায় কথায় আমরাও আজকাল কয়লা খুঁজি মাংস ঝলসানোর জন্য। তার সে কী আয়োজন! সে কী পরিকল্পনা শুধু সেই ঝলসানো মাংসের নেশায়—যে নেশার নিশানা আছে আমাদের জিনে। কেউ পেঁয়াজ মরিচের সঙ্গে সার বেঁধে নিয়ম করে শিকে গাঁথে নেবে টুকরো করা মাংস, কেউ পাতলা ফালি মাংস সোজা কয়লার আগুনের ওপর ফেলবে। হিশশশশশ করে শব্দ উঠবে গরম তাওয়ায়, নেটে, লোহার গ্রিলে; চিড়বিড় শব্দ করে এদিক সেদিক তেল ছিটকে পড়বে, তেল চর্বির ফোটায়ফোটায় সাদা ঘন সুগন্ধি ধোঁয়ায় ছেয়ে যাবে সবদিক, এই পোড়া চর্বির সুগন্ধে একটা মাতাল করা ব্যাপার আছে কিন্তু!

এই মাতাল সুগন্ধ পৌঁছে যাবে আনাচকানাচে, পুরো এলাকা মৌ মৌ করবে পোড়া চর্বির সুবাসে... আহা! গরমা গরম ঝলসানো মাংস আগুনের ওপর থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে হামলে পড়বে সবাই সেই আদিম কালের ক্ষুধা মেটাতে।

স্টেকের সঙ্গে পছন্দমতো অনেককিছুই খাওয়া যায়
ছবি: লেখক

এই মাংসের সঙ্গে বাহাস হবে পরোটার, রুটির, টকমিষ্টি ঝাল ঝাল আচারের, পেঁয়াজের, রায়তার, সালাদের। এই ঝলসানো মাংস কারওটা পুড়ে যাবে, কারওটার ভেতরটা এখনো একটু কাঁচা কাঁচা, কারওটা রাবারের মতো শক্ত, কারওটায় বেশি মরিচ পড়ে গেছে, কোনোটায় লবণ বেশি, তবু শত অভিযোগের মধ্যেও একটুও অবশিষ্ট থাকবে না, চেটে পুটে আঙুল চুষতে চুষতে শেষ করবে সবাই। আমরা বাঘের চেয়ে কম কীসে? ঝলসানো মাংসের হাতছানি তো এমনই।

এত ভিন্ন ধরনের ঝলসানো মাংসের মধ্যে একটা বিশেষ ধরন, যাকে আমরা স্টেক বলি, সেটা নিয়ে আলাপ করি একটু। কারণ কাবাব জাতীয় ঝলসানো মাংস তো আমরা ভালোই চিনি, তবে স্টেক জিনিসটা আমাদের এখানে অপেক্ষাকৃত নতুন আমদানি।

হালে আমাদের স্টেকের প্রতি একটা বিশেষ ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। বাসায় কিন্তু বেশ ভালো, প্রায় পেশাদারি স্টেক ওয়ালাদের মতো স্টেক বানানো খুব একটা কঠিন নয়। কয়েকটা বিষয় মনে রাখলেই এমন স্টেক বানানো যায় যে সবাই ট্যারা হয়ে যাবে। আজকাল বেশ জনপ্রিয় কিছু বাংলা রেসিপি চ্যানেল, যাদের কিনা কোটি কোটি লাইক, তাদের দেখছি বেশ দক্ষতার সঙ্গে সবাইকে ঘোল খাইয়ে রেসিপি শেখাচ্ছে, ‘জোশ আইটেম, বানাইবেন আর খাইবেন’ জাতীয় গিমিক দিয়ে। সবাইকে বোঝাচ্ছে, বাসায় আসলে এর থেকে বেশি কিছু করার নেই, যা দেখাচ্ছি তাই কাফি।

হালে আমাদের স্টেকের প্রতি একটা বিশেষ ভালোবাসা তৈরি হয়েছে
ছবি: উইকিপিডিয়া

তারাও স্টেক বানিয়ে দেখাচ্ছেন, কিন্তু সে স্টেকটা খেতে যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টায়ার চিবুনোর মতো শক্তিশালী চোয়াল থাকতে হবে, সেটা অনেকেই বুঝতে পারছেন না। কিন্তু রেসিপির রহস্য একটু খুলে বললেই রান্না হতো আসলে অনেক ভালো স্টেক। আসলে তারাও তো অন্য কারওটা দেখেই ভিডিও বানান। রান্নার সহজাত অভিজ্ঞতা কতটুকুইবা।

যদি বিদেশি রেসিপির কিছু খেতেই হয় তাহলে আসলটা না হোক অন্তত কাছাকাছি কিছু একটাচেষ্টা করা উচিত। তবে হ্যাঁ, বাসার রান্না বিদেশি রেসিপি আসলের মতো হওয়া প্রায় অসম্ভব আর প্রত্যেকের রান্নার নিজস্বতা থাকে। রেসিপিতে টুইস্ট থাকবে কিন্তু শেষমেশ খাবারটা উপাদেয় হতে হবে। তবু গোল দেওয়ার চেষ্টাতো করতে হবে, গোল না হয়ে হয়তো গোলপোস্টের পাশ দিয়ে বল যাবে। কিন্তু ধারণাটাই যদি ভুল হয় তাহলে অন্য কিছু হবে সেই রেসিপির আইটেম হবে না।

স্টেকে ফিরে আসি। ধরুন গরুর স্টেক রান্নায় প্রথমেই জানা দরকার স্টেকের বিভিন্ন কাট কী, কোনটা ভালো, কতটুকু চর্বি আর মার্বেলিং থাকবে এবং আপনার স্টেকটাই বা কী? গরুর কোন অংশের স্টেক, তার ওপর ভিত্তি করে কত কত নাম তাদের— টি বোন, রিব আই, স্ট্রিপ, টেন্ডার লাইন, স্কার্ট, ফ্ল্যাঙ্ক। প্রকারভেদ নিয়েই এত এত আলোচনা হতে পারে।

স্টেকের জন্য আছে মাংসের বিভিন্ন কাট
ছবি: উইকিপিডিয়া

যা হোক, যে স্টেকই আপনার হাতে থাকুক না কোনো, জানতে হবে, স্টেকের সুন্দর মাংসের ফ্লেভারটা আসলে আসে কোথা থেকে। রান্না স্টেকের ওপর হালকা পোড়া শক্ত ক্রাস্টটাই স্টেকের সুন্দর স্বাদের উৎস। বেশি মসলা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ মেখে রেখে সুগন্ধ চাপা দেওয়ার আগে ভেবে দেখা উচিত, আমরা কেন স্টেক খেতে চাচ্ছি, স্টেক চাচ্ছি না কাবাব খেতে চাচ্ছি। এই ক্রাস্টটা তৈরি করতে হয় স্টেককে সিয়ারিং করে। সিয়ারিংহলো উচ্চতাপে মাংসেরউপরিভাগ খুব কম সময়ে সংকুচিত করে ফেলা, যাতে ভেতরের জুস বের না হয়ে আটকা পড়ে সেই ফ্লেভার ফুলক্রাস্ট তৈরি হয়।

এই ক্রাস্ট কিন্তু স্টেক পুড়ে যাওয়া নয়। সিয়ারিং এর সময় এই ক্রাস্ট তৈরি হয় মেইলার্ড রিঅ্যাকশনের কারণে। মেইলার্ড রিঅ্যাকশন মূলত উচ্চতাপে শর্করার সঙ্গে প্রোটিনের বিভিন্ন এমাইনো অ্যাসিডের বিক্রিয়া। তবে এই মেইলার্ড রিঅ্যাকশনের জন্য ৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার চেয়ে বেশি তাপমাত্রা দরকার। রেস্টুরেন্টের চার-ব্রয়লার বা পেশাদার বারবিকিউ গ্রিলে এর থেকে অনেক বেশি তাপমাত্রায় রান্না হয়।

কিন্তু বাসায় সেই তাপমাত্রা পেতে কী করা যাবে?

তাওয়া বা গ্রিল প্যান গরম হলে কয়েক ফোঁটা পানি ফেলুন, দেখবেন সঙ্গে সঙ্গে পানি বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা বেশি তাপমাত্রা হলে পানির ফোঁটা পড়ার পরপরই বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে না। তখন পানির ফোঁটাগুলো কিছুক্ষণ পারদের মতো প্যানময় দৌড়ে বেড়াবে। এমন হয়ে থাকে লাইডেন ফ্রস্ট এফেক্টের কারণে। ৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি তাপমাত্রায় পানির ফোঁটাগুলো প্যানে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁটাগুলোর নিচে বাষ্পের একটা পাতলা আস্তরণ তৈরি করে। ফলে ফোঁটাগুলো সরাসরি প্যানের সংস্পর্শে আসতে পারে না, তাই পিছলে বেড়ায়। এই পিছলে বেড়ানই লাইডেন ফ্রস্ট এফেক্ট। এমন হলেই বুঝতে হবে তাপ ঠিক আছে।

সিয়ারিং এর সময় এই ক্রাস্ট তৈরি হয় মেইলার্ড রিঅ্যাকশনের কারণে। মেইলার্ড রিঅ্যাকশন মূলত উচ্চতাপে শর্করার সঙ্গে প্রোটিনের বিভিন্ন এমাইনো অ্যাসিডের বিক্রিয়া। তবে এই মেইলার্ড রিঅ্যাকশনের জন্য ৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার চেয়ে বেশি তাপমাত্রা দরকার।

এত গেল তাপমাত্রা। স্টেক রান্নার আরেকটা কৌশল হলো, মাংসের ফালিগুলো শুকনো হওয়া। বেশ ভালো করে টাওয়েল বা টিস্যু দিয়ে মাংসের ফালিগুলো শুকিয়ে নিয়ে এবং কোনো মসলা দিয়ে মাখিয়ে না রেখে (ম্যারিনেট না করে) শুধু লবণ আর টাটকা গোলমরিচ গুঁড়ো মাখিয়ে তাড়াতাড়ি প্যানে দিয়ে দেওয়া। প্যানে আগেই একটু তেল ব্রাশ করে নিতে হবে। কিন্তু বেশি তেল দেওয়া যাবে না। লবণ মাখিয়ে বেশিক্ষণ, মানে তিন চার মিনিটের বেশি রেখে দিলে লবণ মাংসের ভেতর থেকে ওসমসিস প্রক্রিয়ায় পানি টেনে বের করে আনবে। গোলমরিচ টাটকা গুঁড়ো করতে হবে। গোলমরিচ গুঁড়ো রেখে দিলে ঘ্রাণ থাকে না। তবে গুঁড়ো মানে পাউডার নয়, ভাঙা ভাঙা।

স্টেক প্যানে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ শব্দ হতে থাকবে। ঝলসানোর শব্দ পেলেই বুঝতে হবে স্টেক ঠিকঠাক মতো হচ্ছে। স্টেক রান্না এই পর্যায়ে আমরা প্রথম ভুলটা করি— স্টেক প্যানে লেগে যাওয়ার ভয়ে আমরা স্টেকটা নাড়াচাড়া করি। নাড়াচাড়া না করে প্যানে লাগতে দিন, সিয়ারিং ভালো হবে। স্টেক বারবার উল্টানোও যাবে না। স্টেক উল্টোতে হয় মাত্র একবার। সিয়ারিং হয়ে গেলে প্যান থেকে এমনিই স্টেকটা উঠে আসবে। যা কিনা তিন থেকে পাঁচ মিনিট।

স্টেক বারবার উল্টানোও যাবে না। স্টেক উল্টোতে হয় মাত্র একবার
ছবি: উইকিপিডিয়া

সময়টা পার হলে এবার স্টেক উল্টে দিন। এই পাশেও একইভাবে রেখে দিতে হবে। মাঝারি সাইজ আর থিকনেসের স্টেক হলে প্রতি পাশে তিন থেকে পাঁচ মিনিট রান্না করলেই খেতে সবচেয়ে মজা হয়, ভেতরটা সুন্দর গোলাপি আর রসে টইটুম্বুর থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এই মিডিয়াম রেয়ার বা রেয়ার স্টেক খেতে অনেকেই পছন্দ করবেন না। অবশ্য এমন স্টেক খাওয়া খুব একটা ভালোও নয়। যদিও আমি বলবো, কাঁচা না বলে একবার খেয়েই দেখুন আমার মতো ভক্ত হয়ে যাবেন।

ওয়েল ডান হতে গেলে দ্বিতীয় পাশটা আরও বেশ কিছুক্ষণ প্যানে রাখুন, পাঁচ মিনিট পর আঁচ কমিয়ে মিডিয়াম করে দিন, না হলে পুড়ে যাবে। তবে দ্বিতীয় পাশটা দশ মিনিটের বেশি লাগবেই না। শেষ পাঁচ মিনিটে কিছুটা মাখন প্যানে দিয়ে দিতে পারেন। গলে যাওয়া মাখন চামচ দিয়ে স্টেকের ওপরেও দিতে থাকুন। কয়েকটা রসুন কোয়া আর রোজমেরি দিতে পারেন।

ভালো স্টেকের সিক্রেট হলো, রান্নার পর এক টুকরো মাখন ওপরে রেখে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে স্টেকটাকে অন্তত পাঁচ মিনিট রেস্ট করতে দেওয়া
ছবি: প্রথম আলো

স্টেকের মজা সবচেয়ে বেশি হারাই আমরা চুলা থেকে নামিয়েই খাওয়ার চেষ্টা করে। ভালো স্টেকের সিক্রেট হলো, রান্নার পর এক টুকরো মাখন ওপরে রেখে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে স্টেকটাকে অন্তত পাঁচ মিনিট রেস্ট করতে দেওয়া। অবশ্যই রেস্টটা করতে দিন, বিশ্বাস করুন, আপনি নিজেই অবাক হয়ে যাবেন এর স্বাদে। প্রচণ্ড তাপে মাংসের রস মাঝখানে জমা হয়। রেস্ট করতে দিলে রস আবার চার দিকে ছড়িয়ে স্টেক জুসি হয়ে উঠে।

পাঁচ মিনিট পরে যখন ফয়েল খুলবেন, দেখবেন কিছু জুস জমা হয়েছে। এই জুস ফেলে না দিয়ে স্টেকের ওপর ছড়িয়ে দিন। মাখনের সঙ্গে মিলে সেটাই সস হিসেবে কাজ করবে। এ জুস স্টেকের সঙ্গে আপনার যা খুশি খান। তবে একবার পেপার সস দিয়ে খেয়ে দেখুন।