ভেজিটারিয়ানিজম বা নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আর এই ভেজিটারিয়ানিজমের চরমাবস্থা হচ্ছে ভেগানিজম। যাঁরা ভেগানিজম অনুসরণ করেন, তাঁদের ভেগান বলা হয়। ১ নভেম্বর বিশ্ব ভেগান দিবস। ১৯৯৪ সাল থেকে সারা বিশ্বের ‘ভেগান সম্প্রদায়’ দিবসটি উদ্যাপন করে আসছে। মূলত, যাঁরা নিজেদের জীবনধারা থেকে প্রাণীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব ধরনের খাদ্য ও পণ্য এড়িয়ে চলেন, তাঁরাই ভেগান।
বর্তমান বিশ্বে ডায়েট হিসেবে ভেগানিজমের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। তবে এটি শুধু একটি খাদ্যাভ্যাস নয়, এটি একটি দর্শন ও জীবনধারাও বটে। ভেগানরা প্রাণিজ আমিষজাতীয় খাদ্য পরিহারের পাশাপাশি যে ধরনের পণ্য প্রাণী থেকে পাওয়া যায়, এসব পরিহার করেন। কীভাবে এই জীবনধারার শুরু হলো, তা জানতে আমাদের চোখ রাখতে হবে ইতিহাসের পাতায়।
এশিয়াতে প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় কারণে খাদ্য হিসেবে মাছ–মাংস না খাওয়ার চর্চা করা হয়। বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অনুসারীদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। এসব ধর্মে জীবের ক্ষতি করাকে পাপের সমান বলা হয়। পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, গ্রিস ও এর আশপাশের এলাকাগুলোয় প্রাণ আছে—এমন যেকোনো জিনিস পরিহার করতে দেখা যেত। এই অঞ্চলে ভেজিটারিয়ানিজমের কথা প্রথম উল্লেখ করেন গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। প্রাণী ভক্ষণের বিরোধিতা করে তিনি বলেছিলেন, মানুষের উচিত আত্মা হিসেবে সব প্রাণীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো।
আধুনিক যুগে প্রথম ভেজিটারিয়ান সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৭ সালে, ইংল্যান্ডে। এর তিন বছর পর ‘আমেরিকান ভেজিটারিয়ান সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত গ্রাহাম ক্যাকারসের উদ্ভাবক সিলভেস্টার গ্রাহাম। এই গ্রাহাম ছিলেন প্রেসবিটেরিয়ান মিনিস্টার। যার সুবাদে তাঁর অনুসারী ছিল অনেক। এই অনুসারীদের মাধ্যমে উত্তর আমেরিকায় ভেজিটারিয়ানিজম ধারা বেশ দ্রুত প্রসার ঘটে।
এর প্রায় ১০০ বছর পর, ১৯৪৪ সালের নভেম্বর মাসে ইংল্যান্ডে ডোনাল্ড ওয়াটসন নামের এক কাঠমিস্ত্রি ভেগান সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই ‘ভেগান’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন তিনি। নন–ডেইরি ও পোলট্রি ভেজিটারিয়ানদের বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়। ওয়াটসন প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করতেন। ভেগান সোসাইটি মনে করে, মানুষের উচিত প্রাণীদের শোষণ না করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। তাদের কাছে ভেজিটারিয়ানিজম যথেষ্ট নয়। তারা দুধ, ডিম, মধু খাওয়া, পোশাক তৈরিতে উল, পালক আর গয়না হিসেবে মুক্তার ব্যবহারকেও একরকমের প্রাণী শোষণ মনে করেন। মাছ-মাংস ভক্ষণ আর সেগুলোর চামড়া, হাড়, দাঁত ও কাঁটা দিয়ে বিভিন্ন পণ্য বানানোকে তাঁরা নিষ্ঠুরতা হিসেবে দেখেন।
গত কয়েক বছরে বিশ্বে ভেগানদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছে। বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ এখন ভেগান। ধারণা করা হচ্ছে আগামী কয়েক বছরে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য এবং স্বাস্থ্যকর হওয়ার কারণে বর্তমানে ভেগানিজমের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
একটি সিঙ্গেল সার্ভিং স্টেক উৎপাদন করতে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হয়, তা তিন মাইল গাড়ি চালানোর সমপরিমাণ। এ ছাড়া এই কারণে প্রচুর পরিমাণ পানির অপচয়ও হয়। এ থেকে বোঝা যায়, গবাদিপশু উৎপাদন পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিশ্বে প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রাণীজাত খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। বিশাল এই জনসংখ্যার প্রাণিজ খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে প্রচুর খামার আছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস (কার্বন, মিথেন) নিঃসরণ হয়, তার ১৫ শতাংশ খামারজাত পশুর কারণে হয়ে থাকে, যা সব ধরনের যানবাহন ব্যবহারের কারণে যে গ্যাস নিঃসরিত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। ইউনিভার্সিটি অব সান্তা বারবারার ক্লাইমেট ল্যাবের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি সিঙ্গেল সার্ভিং স্টেক উৎপাদন করতে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হয়, তা তিন মাইল গাড়ি চালানোর সমপরিমাণ। এ ছাড়া এই কারণে প্রচুর পরিমাণ পানির অপচয়ও হয়। এ থেকে বোঝা যায়, গবাদিপশু উৎপাদন পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ। এ জন্য পরিবেশবাদীরা সবাইকে ভেগান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, শাকসবজি উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি এবং পানির অপচয় কম হয়।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্যগত কারণে ভেগান ডায়েট সবদিক থেকে এগিয়ে আছে। আমেরিকান বায়োকেমিস্ট টি কলিন ক্যাম্পবেল দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যে পুষ্টিকর খাবারের প্রভাব নিয়ে গবেষণার জন্য বেশ বিখ্যাত। তিনি তাঁর ‘দ্য চায়না স্টাডিস: ফ্যাক্ট অ্যান্ড ফিকশন’ নামের বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ভেগান সংস্কৃতির মানুষ সর্বভোজীদের চেয়ে ভালো স্বাস্থ্য উপভোগ করে থাকে। আবার ‘আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন’–এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা গেছে, শাকসবজি ও ফলে থাকা বিভিন্ন ফাইটোকেমিক্যালস (উদ্ভিদে থাকা বিশেষ প্রাকৃতিক রাসায়নিক, যা রং ও গন্ধ সৃষ্টি করে) শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন ফল ও সবজিতে প্রায় ৪ হাজার ফাইটোকেমিক্যাল আছে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
দীর্ঘমেয়াদি রোগবালাইয়ের আশঙ্কা হ্রাস করার ক্ষেত্রে ভেগান ডায়েটের কার্যকারিতা সুস্পষ্ট। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা ভেগান, তাঁদের মধ্যে টাইপ টু ডায়বেটিস, হৃদ্রোগ ও উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা কম। অনেক ক্যানসার প্রতিরোধে এই ডায়েট সাহায্য করে। এ ছাড়া আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি কমায় ভেগান ডায়েট।
ভেগান ডায়েট ওজন কমাতেও বেশ কার্যকর। অন্যদিকে, প্রচুর ভিটামিন মিনারেল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ ভেগান ডায়েট ত্বকের জন্য ভালো। এ জন্য এখন অনেক সৌন্দর্যসচেতন মানুষ ভেগান ডায়েট অনুসরণ করছেন।
বিশ্বে ভেগান খাবারের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পুষ্টিবিদ ও রন্ধনশিল্পী ভেগান খাবার নিয়ে গবেষণা করছেন। আমিষ, মাংস, দুধ ও ডিমের উদ্ভিজ্জ বিকল্প তৈরি হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে এ ধরনের খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কেবল ইউরোপেই মাত্র চার বছরে (২০১৪-১৮) মাংসের বিকল্প খাদ্যপণ্য, যেমন: টফু, টেম্পে, সেইটান ইত্যাদির বিক্রি প্রায় ৪৫১ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে প্রায় প্রতিটি দেশেই উদ্ভিজ্জ দুধের ব্যাপক প্রসার বাড়ছে। কফি ও টি শপগুলোয় গরুর দুধের পাশাপাশি বাদামের দুধের অপশন রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশেও কয়েকটি ক্যাফেতে এমন দেখা গিয়েছে।
বিশ্বে প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই ভেগানবান্ধব নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি পুরোনো রেস্টুরেন্টগুলো ভেগানবান্ধবে পরিণত হচ্ছে। ম্যাকডোনাল্ডের মতো আরও অনেক বিখ্যাত ফাস্ট ফুড আউটলেটে ভেগান বার্গার, সসেজ, পিৎজা, এমনকি চিকেন ফ্রাই পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্বে প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই ভেগানবান্ধব নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি পুরোনো রেস্টুরেন্টগুলো ভেগানবান্ধবে পরিণত হচ্ছে। ম্যাকডোনাল্ডের মতো আরও অনেক বিখ্যাত ফাস্ট ফুড আউটলেটে ভেগান বার্গার, সসেজ, পিৎজা, এমনকি চিকেন ফ্রাই পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। যাঁরা ভেগান নন, তাঁরাও কৌতুহলবশত এসব খাবার চেখে দেখছেন। স্বাদ নিতে গিয়ে এ খাবারের প্রেমে পড়ে ভেগান হওয়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেগান ইনফ্লুয়েন্সাররা বেশ সক্রিয়। এখানে তাঁরা প্রায়ই ভেগান ডায়েট কীভাবে তাঁদের জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে, কীভাবে পুষ্টিকর ভেগান খাবার রান্না করা যায় ইত্যাদির ভিডিও পোস্ট করে সবাইকে ভেগান হতে উৎসাহিত করছেন। বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ, ওয়াকিন ফিনিক্স, লিজ্জো, আরিয়ানা গ্রান্ডে, জেসিকা চ্যাস্টেইন, সেরেনা ও ভেনাস উইলিয়ামদের মতো বড় বড় সেলিব্রেটি ভেগান ডায়েট মেনে চলেন।
প্রাণী অধিকার, পরিবেশ রক্ষা এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা—এ তিন বিশ্বাসই ভেগানিজমের চালিকা শক্তি। ভেগানিজমের মতো নৈতিক ও টেকসই জীবনধারা এখন রীতিমতো একটি বিপ্লবে পরিণত হয়েছে। আগামী বছরগুলোয় এই বিপ্লবের গতিধারা অব্যাহত থাকবে। বাড়বে ভেগানদের সংখ্যা আর এতে মানুষের পাশাপাশি সুস্থ থাকবে আমাদের প্রিয় পৃথিবী।
তথ্যসূত্র: দ্য ভেগান সোসাইটি, হেলথলাইন, টাইমস, ভেগান বিট, ডয়চে ভেলে, বিবিসি, ক্লাইমেট ল্যাব