বেতাল গরমের তাল
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তালের কী সম্পর্ক, সেটা এক রহস্যময় প্রশ্নই বটে। সম্পর্ক তো আছেই এবং সেটা সরাসরি। ‘তালপাকা গরম’ বলে বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, বাঙালি মাত্রই যেটা ব্যবহার করে থাকেন। গরম না হলে তাল পাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। সে গরমটা হয় এই বাংলা ভাদ্র মাসে। চিটপিটে গরম, ভ্যাপসা গরম, যা-ই বলি না কেন, তালপাকা গরম তা-ই। কিন্তু দেখুন, এবার কী এক অদ্ভুত আবহাওয়া বিরাজ করছে! আকাশে মেঘের ঘনঘটা, হঠাৎ করে নেমে পড়ছে বৃষ্টি। আমরা ইলিশের ভাজা দিয়ে খাচ্ছি খিচুড়ি। আর তাল?
বসন্তের সেই কবিতার মতো বলতেই হয়, গরম পড়ুক আর না-ই পড়ুক তাল পেকেছে। শুধু তা-ই নয়, পাকা তালে এখন তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন খাবার।
পাকা তালের রস বা কাইয়ের সঙ্গে চালের গুঁড়া আর গমের আটা মিশিয়ে বানানো হয় তালের বড়া, চালের গুঁড়া মিশিয়ে বানানো হয় পিঠা, দুধের সঙ্গে তালের রস মিশিয়ে বানানো হয় তালক্ষীর। এ ছাড়া কোথাও কোথাও খাওয়া হয় তালের রুমালি রুটি, ময়দা-আটার সঙ্গে মেখে পরোটা। তালের সরু চাকলি মানে তাওয়ার ওপর রেখে বানানো হলদে সাদা রঙের ফিনফিনে দোসা ক্ষীরে ডুবিয়েই যা খাওয়ার নিয়ম। এ ছাড়া এই আধুনিক সময়ে রন্ধন পটীয়সীরা তৈরি করে থাকেন কলাপাতায় তালপিঠা, তালের স্পঞ্জ কেক, কেক গ্লেইজ। চিন্তার কোনো কারণ নেই, রন্ধনপ্রণালি একটা দেওয়া হবে সঙ্গে। সেটা দেখে বানাতে পারবেন তালের কেক।
সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় তালের ফুলুরি। অমৃত লাল বসু বলেছেন, ‘তাল ফুলুরির তত্ত্বে করিয়া জমক/ ধার্য হল লোক মাঝে লাগাবে চমক।’ আটার সঙ্গে তালরস বা কাই মিশিয়ে ডুবো তেলে ভেজে নিলেই হয়ে যায় তালফুলুরি। নোনতা নাকি মিষ্টি, সে স্বাদের ব্যাপারটা নির্ভর করবে ‘খানেওয়ালা’দের ওপর—নোনতা খেলে লবণ আর মিষ্টি খেলে গুড়। সাধারণত মানুষ তালফুলুরি মিষ্টিই খায়।
তাল কিন্তু বাঙালি জীবনে বহু পুরোনো ব্যাপার। ঘটি না ডুবলেও বাঙালি পুকুরের নাম রাখে ‘তালপুকুর’। বাঙালির যাপিত জীবনে তালগাছ কেন পুকুরপাড়ে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আর যেসব ব্যাখ্যা পাবেন, সেসব শুনলে বেতাল হয়ে যেতে পারেন। তা ছাড়া বাঙালি তিলকেও তাল বানাতে পারে। বলা উচিত, তিলকে তাল বানাতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। কেন তিল তাল হয়, সে ব্যাখ্যাও নেই বাঙালির জীবনে। সম্ভবত এসব ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না বলেই বাঙালি তালপাখা দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে তাল পাতায় লেখা পুঁথির গল্পে ডুবে যেতে ভালোবাসে।
সে যা হোক, তালপাখা দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে আপনি তালফুলুরি যখন-তখন খেতেই পারেন। একদিন বরং ফারাহ্ সুবর্ণার প্রণালিতে তৈরি করে নিন তালের কেক।
তালের কেক
উপকরণ: তালের ক্বাথ ১ কাপ, চালের গুঁড়া ১ কাপ, ময়দা সিকি কাপ, চিনি ১ কাপ, ডিম ১টা, তরল দুধ পৌনে ১ কাপ, কোরানো নারকেল আধা কাপ, বেকিং পাউডার ১ চা-চামচ ও তেল মোল্ডে মাখানোর জন্য।
প্রণালি: একটা বড় পাত্রে কোরানো নারকেল বাদে বাকি শুকনা উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। আলাদা একটা পাত্রে ডিম ভালো করে ফেটিয়ে নিন। চিনি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর ডিম-চিনির মিশ্রণের সঙ্গে তালের ক্বাথ ও দুধ দিয়ে মসৃণ করে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার শুকনা উপকরণের সঙ্গে এই মিশ্রণ ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। অল্প কিছু কোরানো নারকেল কেকের ওপর ছড়ানোর জন্য রেখে দিন। বাকি কোরানো নারকেল তাল-চালের গুঁড়ার তরল মিশ্রণের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে। এখন ছোট ছোট কাপে বা মোল্ডে অল্প তেল মেখে নিন। মোল্ডে অর্ধেকের একটু বেশি মিশ্রণ ঢেলে দিন। একটা স্টিমারের ওপরে কাপগুলো বসিয়ে নিতে হবে। একটা পাত্রে পানি দিয়ে (পানির পরিমাণ এমন হবে যাতে স্টিমারের অর্ধেকটা ডুবে থাকে পানিতে) তার ওপর স্টিমারটা বসিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন।
১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো স্টিম করে একটা টুথপিক কেকের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখুন। টুথপিকটি পরিষ্কার বের হয়ে এলে কেক নামিয়ে ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন। ছোট মোল্ডে করলে সময় কম লাগবে আর বড় মোল্ডে করলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট লাগবে। চুলার আঁচ অবশ্যই মাঝারি রাখতে হবে।