প্রসূতি মায়ের খাবারদাবার
মায়ের কোলে শিশু হাসে। অবশ্য মা হাসলে তবেই তো শিশু হাসবে। মায়ের মুখের ভাষা শিশুর বুলি হয়ে ফুটে ওঠে। মা হেসে দু-দুটি আদরমাখা কথা বললে, আদরের স্পর্শ বুলিয়ে দিলে যে শিশুর কান্না থেমে যায়, এ তো বাস্তবে চোখ-কানের সীমানায় ঘটা বিষয়। তবে মায়ের পুষ্টিতেই যে সদ্য জন্মানো শিশুটিরও পুষ্টি, তা–ও তো আর সাধারণ বুদ্ধির বাইরের বিষয় নয়। তবু এখনো কেন যেন হেলাফেলা করা হয় মায়ের স্বাস্থ্যকে, পুষ্টিকে। যা দেখলে বেগম রোকেয়ার লেখনীর ‘সুকুমারী গোলাপ-লতিকায় কাঁঠাল ফলাইতে চাহেন’ অংশটা মনে পড়তে পারে। যদিও বাক্যাংশটি মেয়েদের ব্যায়াম প্রসঙ্গে উত্থাপিত, তবে মায়ের পুষ্টির দিকটাও একইভাবে ‘তাঁহারা দৌহিত্রকে হৃষ্টপুষ্ট “পাহল-ওয়ান” দেখিতে চাহেন কি না?’-এর সঙ্গে জড়িত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবাসসুম গনি বলেন, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মায়ের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। মায়ের শক্তি পূরণ করতে, রক্তের ঘাটতি পূরণ করতে আর পানির চাহিদা পূরণ করতে সচেষ্ট থাকতে হবে। আর নবজাতকের দেহে মায়ের দুধের মাধ্যমেই শর্করা, আমিষ, স্নেহজাতীয় খাবারসহ সব ধরনের পুষ্টি উপাদান পৌঁছায়। প্রথম ছয় মাস শিশুর অন্য কোনো খাবারের প্রয়োজন তো নেই-ই (এমনকি পানিও নয়), বরং এ সময় শিশুকে অন্য কোনো খাবার দেওয়া হলে সেটির কারণে নানা ঝক্কি পোহাতে হতে পারে। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর পুষ্টির উৎস সম্পূর্ণভাবেই কেবল মা। তাই মায়ের সুষম খাদ্যতালিকার কোনো বিকল্প নেই।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, সন্তান জন্ম নেওয়ার পর থেকেই মায়ের প্রচুর পানি বা তরল খাবার প্রয়োজন। মায়ের দুধের প্রবাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত (মোটামুটিভাবে ১৫ দিন থেকে ২ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে) দৈনিক ৪ থেকে সাড়ে ৪ লিটার তরল গ্রহণ করতে হবে। এরপর দৈনিক আড়াই থেকে ৩ লিটার তরল গ্রহণ করাই যথেষ্ট। প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর আগে মা তরল পান করে নেবেন।
প্রথম কয়েক দিন
সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মাকে প্রথম তিন দিন প্রচুর তরল খেতে হবে। মুরগির স্যুপ, জাউভাত, লাল চা খেতে পারেন। প্রথম ছয় সপ্তাহ অবশ্যই উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন খাবার খেতে হবে। আমিষ গ্রহণ করুন পর্যাপ্ত। দুধ, ডাল, পানিজাতীয় সবজি (যেমন লাউ, জালি, পেঁপে) এবং ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। খাবার ঝোল করে রান্না হওয়া প্রয়োজন। নরম ভাত খেতে পারেন।
ক্যালরির হিসাব-নিকাশ
গর্ভকালীন শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন যত ক্যালরি গ্রহণ করা হয়েছে, তার চেয়ে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ ক্যালরি বেশি গ্রহণ করার পরামর্শ দিলেন শামসুন্নাহার নাহিদ। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এই পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়। আমিষও চাই পর্যাপ্ত। এই হিসাবে সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ছয় মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত। ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে শিশুকে বাড়তি খাবার দেওয়ার নিয়ম। তাই ছয় মাস অন্তর মায়ের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে ২০০ ক্যালরি করে কমিয়ে আনা যায়। তবে এটি একটি গড়পড়তা হিসাব। মায়ের ক্যালরি গ্রহণ নির্ভর করে শিশুর মায়ের দুধের পর্যাপ্ততা ও শিশুর ওজন বৃদ্ধির হারের ওপর। মায়ের শরীরের নানান অবস্থা বুঝে তবেই হিসাব করা যাবে প্রয়োজনীয় ক্যালরি। তাই সবটা না জেনে কিছুই ধরাবাঁধা নির্দিষ্ট নিয়ম হিসেবে ঠিক করে ফেলা যাবে না। মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে সারা দিনের খাবারটাকে কয়েক ভাগে ভাগ করে নিতে হবে।
যেসব উপাদান প্রয়োজন
পানি আর আমিষের বাড়তি চাহিদার কথা তো জানা হলো। এ ছাড়া বাড়তি ক্যালসিয়াম আর লৌহ তো লাগছেই। ভিটামিন এ-এর চাহিদা মেটাতে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর ২ লাখ আন্তর্জাতিক ইউনিটের ক্যাপসুল মাকে খাইয়ে দেওয়া হয় বলে জানালেন তাবাসসুম গনি। অন্যান্য খনিজ উপাদান আর ভিটামিনের চাহিদা স্বাভাবিক সময়কার মতোই। ডিম, দুধ, মাছ, মাংস খেতে হবে। অতিপ্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিডের কথা ভুললে চলবে না। শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান নিশ্চিত করতে মাছ খেতে হবে (মাছের তেল ফেলে দেওয়া ঠিক নয়)। টাটকা ফলমূল ও শাকসবজি খেতেই হবে। আঁশসমৃদ্ধ খাবার খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগবেন না।