কয়েক বছর আগে এক মৎস্যজীবীর সঙ্গে ইলিশ নিয়ে কথা হচ্ছিল। বহু বছরের অভিজ্ঞতা তাঁর। সেসব বলতে বলতে তাঁর চোখেমুখে অদ্ভুত স্মৃতির ঝিলিক দৃষ্টিগোচর হয়। যুবতী ইলিশগুলো পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোর আকর্ষণে নদীর জলের উপরিভাগে উঠে আসে। সেগুলোর ঠাটবাটও বেজায়। পুরুষের তুলনায় দেখতেও সুন্দর। স্টাইল আর গ্ল্যামারে পুরুষ ইলিশ মেয়েগুলোর ধারেকাছেও নেই।
একবার বরিশাল যাওয়ার পথে বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ সত্যিই চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয়। সেটি ছিল পূর্ণিমা রাত। মাঝরাতে কেবিন থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়াতেই দেখি জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। জেলেদের জালে ভরা তাল তাল রুপা। পানি থেকে টেনে নৌকায় তুলছেন জালবন্দী ইলিশ।
জেলেরা জানেন ইলিশের মতিগতি। কিছুদিন আগে সুপ্রতিম কর্মকারের একটা লেখা পড়ছিলাম ইলিশ নিয়ে। জেলেদের বরাত দিয়ে তিনি লিখেছেন, ইলিশের দল ঝাঁক বেঁধে যখন যায়, তখন পানি ঘোলাটে হয়ে যায়। সেই পানি থেকে একধরনের গন্ধ ছড়ায়। একে বলা হয় গন্ধঝাঁক।
জেলেরা পানির তল মেপে বুঝতে পারেন, পানির রং দেখে বুঝতে পারেন, আবার গন্ধ শুঁকেও। সেদিন এই বিষয় নিয়ে আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনিও একই গল্প শোনালেন। এই জলের নানা রং, নানা নাম। তা দেখেই বলা যায় ইলিশের ঝাঁক আসছে, নাকি চলে গেছে।
করোনাকালের সুখবর
করোনাকালে ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর উজিয়ে সুখবর বয়ে এনেছে ইলিশ। দূষণমুক্ত থাকায় এই সময়ে এগুলো কেবল গায়েগতরেই বাড়েনি, বেড়েছে সংখ্যায়ও। বর্তমানে সারা বিশ্বে ইলিশের মোট উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই বাংলাদেশের (বিশ্বের ৮৬% ইলিশই বাংলাদেশে, ইফতেখার মাহমুদ, প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০)। চার বছর আগে এই পরিমাণ ছিল ৬৫ শতাংশ। ইলিশ নিয়ে যখন ওপার বাংলায় হাপিত্যেশ, তখন বাংলাদেশের বাজারে রমরমিয়ে চলছে ইলিশের বিয়ে।
বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদনের সাফল্যকে এখন বিশ্বের অনেক দেশ মডেল মানছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সহকর্মী ইফতেখার মাহমুদের রিপোর্টে। এই সাফল্যে অনুঘটক হয়েছে মা ও জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধ করা, অভয়াশ্রম বাড়ানো ও জেলেদের সুরক্ষাব্যবস্থা। আর এই অভয়াশ্রমের কারণে ইলিশ বাচ্চা নিয়ে সমুদ্রে চলে গেলেও আবার সেখানেই ফিরে আসছে নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে।
বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় এই ‘মীনসত্তম’ বাংলাদেশের শ্লাঘার প্রতীক হয়েছে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাব, প্রকৃত বাজারব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় ইলিশ নষ্ট হচ্ছে; উপরন্তু এত বছরে বিদেশিদের ইলিশের স্বাদে মজানোর প্রয়াসও লক্ষণীয় নয়। সারা বিশ্বে স্যামন নিয়ে যত প্রগলভতা, তার ছিটেফোঁটাও নেই ইলিশ নিয়ে। কাঁটা বেশি হলেও এর স্বাদ যে অতুলনীয়, সেটি কেবল বাঙালিরাই জানছে; আর সেটি তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে অদ্ভুত আত্মসুখ অনুভব করছে।
অবশ্য এরই মধ্যে সরকার ২৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার ‘ইলিশসম্পদ উন্নয়ন ও পরিচালনা’ প্রকল্প অনুমোদন করেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে (প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০)। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য অধিদপ্তর ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে (৯ ইঞ্চিরও কম লম্বা ইলিশ রক্ষা) এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমে ৬টি অভয়ারণ্য পরিচালনা এবং প্রায় ৩০ হাজার জেলে পরিবারের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা, ১০ হাজার জেলেকে বৈধ জাল সরবরাহ করা এবং বিকল্প চাকরিতে ১৮ হাজার জেলেকে প্রশিক্ষণ প্রদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। তবে পানিদূষণ রোধও ইলিশের উৎপাদনে অনুঘটক হতে পারে, যার প্রমাণ এ বছর পাওয়া গেছে। কাজেই সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
ইলিশ নিয়ে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। আমাদের চাঁদপুর প্রতিনিধি আলম পলাশ জানাচ্ছিলেন, এবার তিনি সাড়ে তিন কেজি ওজনের ইলিশ দেখেছেন। দুই আড়াই কেজি তো দেখেছেনই। অনুকূল পরিবেশ বাংলাদেশের ইলিশের ওজন আর সংখ্যা যে বাড়াবে, তাতে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। যদিও প্রয়োজন যথাযথ সরবরাহব্যবস্থা আর সংরক্ষণ; তাহলে ইলিশ সৌরভ আর আস্বাদে বিমোহিত করতে পারবে সারা দেশের মানুষকে।
কয়েক দিন ফেসবুকে একটা পোস্ট নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে—পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ কেটে বিক্রি নিয়ে। এ নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করছেন। কিন্তু শুভচিন্তার মানুষও আছেন। তাঁদের অনেকেই বলেছেন, এই প্রথা বাংলাদেশে চালু হলে একেবারে সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব হতো সন্তানদের ইলিশ মাছের স্বাদ দেওয়া। এ নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়; বরং সেটা সময়োপযোগী আর বাস্তবসম্মতও। কারণ, ইলিশের আমদানি যতই হোক, অদ্ভুত এক কারণে দাম যে সাধারণের সাধ্যের মধ্যে থাকছে, তা অন্তত বলা যাবে না।
দাদনের দুঃখ এবং আয়ের ভাগ
ইলিশ নিয়ে কথা শুরু করলে শেষ হয় না। যদিও শাস্ত্রকারেরা ইলিশ নয়, রুই বা রোহিতকে মীনশ্রেষ্ঠ বলে গেছেন। তবু বাঙালির কাছে ইলিশই শ্রেষ্ঠ। মৎস্য মহারাজ। ইলিশ প্রসঙ্গে এত বিষয়ের অবতারণা হয় যে বলে শেষ করা যায় না। অথচ যেটা আর অন্য কোনো মাছের ক্ষেত্রে হয় না।
ভারত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ ধরার কৌশলের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলের তফাৎ নেই। আবার দাদন নামের বিষয়টিও আছে উভয় দেশেই। নতুন ট্রলার নামানোর সময়েই মূলত দাদন বা সুদে ধার নিয়ে থাকেন জেলেরা। নৌকা বা ট্রলারের আয়তনের ওপর নির্ভর করে দাদনের পরিমাণ। আর এই টাকা এক মৌসুমে উঠে আসে না; বা শোধ করা সম্ভব হয় না। কয়েক মৌসুম লাগে।
কখনো কখনো এই দাদনের ভার ও দুঃখ বয়ে বেড়াতে হয় প্রজন্মান্তরে। এমনও শোনা যায়, মাছ বেশি আমদানি হলে দাদনদার বা মহাজনেরা মাছের দাম কমিয়ে দেন যাতে জেলেরা দেনা শোধ করতে না পারেন। ফলে অপরিশোধ্য দেনার পরিমাণ বাড়তে থাকে। আর সেই ভার গিয়ে চাপে পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে। সমানে চলতে থাকে সে ঐতিহ্য।
চট্টগ্রামের আনোয়ারার সহকর্মী মোহাম্মদ মোর্শেদ আর চাঁদপুরের সহকর্মী আলম পলাশের সঙ্গে কথা বলে ইলিশ ধরা সম্পর্কে কিছু তথ্য মিলেছে। উভয় জায়গায় জেলেরা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই মানুষ। মুসলমানই সিংহভাগ। তাঁদের নিজস্ব কিছু আচার রয়েছে। সেটা পরে উল্লেখ করা যাচ্ছে।
পলাশ জানিয়েছেন, শরিয়তপুর থেকে কিছু জেলে চাঁদপুরে মাছ ধরতে আসেন, যাঁরা হিন্দু সম্প্রদায়ের। চাঁদপুরের ছোট জেলে নৌকায় সর্বোচ্চ ১২ জন আর সর্বনিম্ন ৪ জন জেলে থাকেন। তাঁরা কয়েক ঘণ্টার জন্য সমুদ্রে যান এবং যে জাল পাতা থাকে, তা থেকে মাছ তুলে নিয়ে চলে আসেন। তাঁদের মাছের পরিমাণ ১০ কেজি থেকে সর্বোচ্চ মণখানেক হয়। অন্যদিকে ৭–১৫ দিনের জন্য যে ট্রলার যায়, তার আমদানি ৩০-৫০ মণ। যে মাছ ধরা হয়, তার সব খরচ বাদ দিয়ে প্রাপ্ত অর্থ সমান ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে কেবল ট্রলারমালিক, যিনি আসলে সেনাপতি, তিনি দুই ভাগ অর্থ পেয়ে থাকেন।
অন্যদিকে মোর্শেদ আরও বিস্তারিতভাবে জানিয়েছেন আনোয়ারার তথ্য। জেলেরা এখানেও দুভাবে ইলিশ ধরেন।
একদল ছোট নৌকা নিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য সমুদ্রে যান এবং তাঁরা পাতা জালে ধরা পড়া ইলিশ তুলে নিয়ে ফিরে আসেন। এমন নৌকায় পাঁচ-আটজন করে জেলে থাকেন। তাঁদের মাছ ধরার পরিমাণ এক থেকে দেড় মণ। তাঁরা অমাবস্যা আর পূর্ণিমার ভরা জোয়ারেই মাছ ধরতে যান। অন্যদিকে ১৫ দিনের জন্য যাঁরা ইলিশ ধরতে যান, তাঁরা এক থেকে দেড় টন মাছ নিয়ে ফেরেন। এ পরিশ্রমের মজুরি নির্ধারিত হয় নানাভাবে। মাছ বিক্রির ওপর কমিশনের ভিত্তিতে যেমন, তেমনি মৌসুম চুক্তিতেও। এখানে দলনেতা অবশ্যই নৌকার মালিক। তিনিই সবচেয়ে বেশি অর্থ পান। এরপর থাকেন জেলেরা। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাঁরা এক মৌসুমে ৪০–৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।
অন্যদিকে ‘ইলিশ পুরাণ’–এর লেখক দিগেন বর্মন জানাচ্ছেন, নৌকা ভাড়া নিয়ে মাছ ধরতে গেলে যে পরিমাণ মাছ ওঠে, তাতে নৌকার জন্য এক ভাগ দিতে হয়। আর জালের জন্য দিতে হয় এক ভাগ। এ ছাড়া যাঁরা মাছ ধরেন, তাঁরা এক ভাগ করে পান। ফলে কারও জাল থাকলে তিনি দুই ভাগ পান। অনেক সময় জালও ভাড়া পাওয়া যায়। দুভাবে মাছ ধরেন জেলেরা—চুক্তি হিসেবে কিংবা মজুরি হিসেবে।
আবার বড় ট্রলারের ক্ষেত্রে ট্রলারের মালিক আর জেলেদের মধ্যে ভাগাভাগিতে জেলেরা পান ৩৮ শতাংশ আর ট্রলারমালিক পান ৬২ শতাংশ। আবার পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের দিকে এই ভাগাভাগি হয় মোট মাছ বিক্রির পর খাবার খরচ বাদ দিয়ে প্রাপ্ত টাকার ওপর। সেখানে টাকা মোট ৩৭ ভাগ করা হয়। ৫ ভাগ পান নৌকা বা ভটভটির মালিক। বাকি ৩২ ভাগকে ১৬ ভাগ করা হয়। এর ৮ ভাগ পান জেলেরা। আর বাকি ৮ ভাগ যায় জালের জন্য। যাঁর জাল নেই, তিনি এক ভাগ পান। এটাকে বলে ‘গা ভাগ’। আর জাল থাকলে দ্বিগুণ।
ইলিশের সংস্কার
মৎস্যজীবীরা বিশ্বাস করেন, একাদশী বা দ্বাদশীর দিন দু–একটা ইলিশ যা ধরা পড়ে, সেগুলোর লুকা বা যকৃৎ হাতে নেওয়ার পর হাত থেকে পিছলে পড়ে গেলে ধরে নেওয়া হয়, সামনের দিনগুলোতে আসছে ইলিশের ঝাঁক।
ইলিশ ধরতে যাওয়ার আগেও নানা আচার-অনুষ্ঠান করে থাকেন মৎস্যজীবী আর তাদের পরিবারের সদস্যরা। চাঁদপুরে তেমন কিছু চোখে পড়েনি পলাশের। তবে আনোয়ারার মৎস্যজীবীদের সংস্কার সম্পর্কে জানিয়েছেন মোর্শেদ। তিনি বলেন, ৯৫ শতাংশ মুসলমান হওয়ায় তাঁরা নতুন নৌকা নামানোর আগে কোরআন শরিফ খতম দেন। কখনো বাড়িতে দেন, কখনোবা নৌকায়। অনেকে পীরের অনুসারী বলে পীরের কাছে মানত করেন। প্রথমবার মাছ ধরে নিয়ে আসার পর পীরের দরগায় পাঠান সে মাছের কিছু অংশ। হিন্দুরা নৌকায় মন্ত্র পড়ে জল ছেটান।
মোর্শেদ আরও জানান, এই সময়ে মাছের আমদানি বেশি থাকে। তাই আত্মীয়স্বজনের বাসায়ও মাছ পাঠানোর রীতি ওই অঞ্চলের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে।
পশ্চিমবাংলার ধীবরেরা প্রথম ধরা মাছটিকে একটি থালায় নিয়ে জালের ওপর রাখেন। তারপর সিঁদুর ও হলুদ মাখিয়ে বরণ করেন। অনেকে আবার বাতাসা চিনি দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে পূজার মতো অনুষ্ঠান করেন। এরপর মাঝের অংশ কেটে নৌকার গলুইয়ের ওপর রাখেন বা পুঁতে দেন।
মৌসুমে প্রথম ইলিশ এলে মসলাবাটার নোড়ার সঙ্গে ইলিশের বিয়ে দেওয়া হয়। এখনো ওপার বাংলার বর্ধিষ্ণু হিন্দু জমিদার পরিবারে এই রেওয়াজ রয়েছে। বছরে প্রথম ইলিশ বাড়িতে আনা হলে তাঁরা এটা করে থাকেন। এপার বাংলায় সরস্বতী আর লক্ষ্মীপূজায় ঠাকুরকে জোড়া ইলিশ নিবেদন করা হয়। কোনো কোনো জায়গায় পৌষ মাসেও সেটা করা হয়। আর সেই ইলিশ কেনার সময় দামদর করা হয় না। তবে দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পর থেকে সরস্বতী পূজা পর্যন্ত ইলিশ খাওয়া হয় না।
পরিযায়ী ও স্বাধীনচেতা
ইলিশ কিন্তু ভীষণই স্বাধীনচেতা। অকূল পাথারেই এর বিচরণ। তাই তো সমুদ্রে থাকতেই এগুলো পছন্দ করে। কিন্তু সংসার-সন্তানের টানও তো আছে। সে জন্যই বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসে নদীতে। উপভোগ করে পরিযায়ী জীবন। সমুদ্রের লোনাপানিতে নষ্ট হয় ডিম। ফলে মিঠাপানিতে এসেই ডিম ছাড়ে। এই আসাই বেশির ভাগ সময়ে কাল হয়। জেলেদের জালবন্দী হয়ে এগুলোর জীবনে যতি পড়ে। এই যে এগুলোর উজিয়ে আসা, সেটিও কৌলিন্যের পরিচায়ক। ইলিশ কখনো গড্ডালিক প্রবাহে গা ভাসায় না। তাই তো স্রোতের বিপরীতেই চলে। এগুলোর সাঁতার অনেকটা টর্পেডোর মতো। শরীরটাও তো তেমন। ঘণ্টায় গতি ৬০ কিলোমিটার পর্যন্তও হয়ে থাকে। এ নিয়ে একটা ছড়াও আছে, ‘ঝড়ের চেয়েও বেগবতী/পেটে ডিম ভরা ইলিশের গতি’।
নদীতে এসে ডিম পাড়ার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। সেই বাচ্চা কিছুটা বড় করে আবার ফিরে যায় বৃহৎ জগতে। পরিযায়ী পাখির মতো ইলিশও দলবদ্ধভাবে চলে। পুরুষ মাছ ওপরের দিকে থাকে। নারী মাছ নিচের সারিতে। ফেরার সময় দলেন মাঝখানে থাকে বাচ্চাগুলো।
ইলিশ নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। বিশেষত এদের খাবার নিয়ে। মরদেহ খাওয়ার কথা প্রায়ই শোনা যায়। বস্তুত তা একেবারেই ভুল। ইলিশ নিরামিষাশী। পানির সবুজ শেওলাই ইলিশের মূল খাদ্য। কোনো নোংরা এগুলো স্পর্শ করে না।
তথ্যঋণ:
ইলিশ পুরাণ, দিগেন বর্মণ
ভোজন শিল্পী বাঙালী, বুদ্ধদেব বসু
মছলিশ, আলপনা ঘোষ,
পাক-প্রণালী, বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়
বাঙালি চার সহস্র বছরের খাদ্যাভাস ও খাদ্যাচার: বিবর্তন ও অনুসন্ধান, শুভদীপ বোয়াল, সপ্তডিঙা, বিশ্বকর্মাপূজা সংখ্যা ২০১৯।