ঐতিহ্যের হালুয়া-রুটি
আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতটি পবিত্র শবে বরাত। সে হিসেবে এবার ৯ এপ্রিল এই শবে বরাত। এরপর মূলত পবিত্র মাহে রমজানের দিনগণনা শুরু হয়। তাই রমজান মাসের আগমনের বার্তা এবং প্রস্তুতির প্রেরণা নিয়ে আসে এই রাত। বিকেল থেকেই শুরু হয় প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে হরেক রকম হালুয়া–রুটি বিতরণের পর্ব।
শবে বরাতের দিনে এই হালুয়া–রুটির অবশ্য ধর্মীয় কোনো তৎপর্য নেই। এটি নেহায়েত সামাজিক রেওয়াজ। ইতিহাসবিদদের অনেকে মনে করেন, আমাদের দেশে এই রেওয়াজ চালু হয়েছিল উনিশ শতকে। সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ নিবিড় করে তুলতে এই বিশেষ ধরনের খাদ্য বিতরণের একটি ভূমিকা আছে। সে যাই হোক, শবে বরাতের হালুয়া এখন যে এক সামাজিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সারা দেশেই এর চল রয়েছে। তবে এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে নিজ নিজ গৃহে থাকায় গৃহবাসীরা হয়তো আগের মতো উৎসবের আমেজে হালুয়া–রুটি বিতরণ করতে পারবেন না। তবে ঘরে ঘরে নিজেদের জন্য এই সুস্বাদু পদটি রান্নার আয়োজন করতে কোনো বাধা নেই।
সুজি, বুট, গাজর, ডিম, বাদাম, পেঁপে, চালকুমড়া, নেসেস্তাসহ হরেক রকমের উপকরণ দিয়েই বৈচিত্র্যময় স্বাদের হালুয়া তৈরি করা যায়। করবেনও অনেকে। তবে হালুয়া নামের এই মিষ্টির উৎপত্তি কবে কোথায়, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আসলে বাঙালির মিষ্টান্নের কোনো লিখিত ইতিহাসই পাওয়া যায় না। আগের কালের মিষ্টান্নের বর্ণনা পাওয়া যায় মূলত মধ্যযুগের সাহিত্য ও ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে। এ ক্ষেত্রে অন্নদা মঙ্গলসহ বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যই খাদ্যাদির সন্ধান লাভের প্রধান উৎস। সেখানে মিষ্টান্নের ভেতরে পাওয়া যায় নাড়ু, মুড়কি, ক্ষীরখণ্ড, সরগুটি, পিষ্টক, খাজা, গজা, সন্দেশ, দই, ক্ষীরসা প্রভৃতি।
হাকীম হাবীবুর রহমান তাঁর ঢাকা: পাচাশ বারস্ পহেলে (ঢাক পঞ্চাশ বছর আগে) বইতে ঢাকার মিষ্টান্নের যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন, তাতে উল্লেখ করেছেন, ঢাকায় বাঙালি ও অবাঙালি উভয় প্রকারেরই উত্তম মিষ্টি তৈরি হতো। বাঙালিদের মিষ্টি মূলত ছানা থেকে তৈরি রসের মিষ্টি এবং অবাঙালি অর্থাৎ হিন্দুস্থানিদের মিষ্টি মাওয়া থেকে তৈরি শুকনো মিষ্টি। ‘হালুয়া’ শব্দটি ইসলামি শব্দ। এ জন্য যেখানে যেখানে হালুয়ায়ী আছে, সে যেকোনো গোত্রেরই হোক, বিশুদ্ধ ইসলামি মিষ্টি বিক্রি করে। যেমন নকুল, শকর পারা, বালুশাহি, সোহান হালুয়া, কমবেশি মিছরি মিষ্ট আর এর সঙ্গে জিলিপি তো আছেই। তবে হালুয়া মূলত হিন্দুস্থানি মিষ্টান্নের শ্রেণিতে পড়ে। তিনি বলছেন, ‘আর এটিও সত্য যে ঢাকায় পাঞ্জাব এবং উত্তর ভারতের মতো হালুয়ার অনুরাগী অধিকসংখ্যক লোক নেই।’
এশিয়াটিক সোসাইটির ঢাকাই খাবার বইতে হাবিবা খাতুন লিখেছেন, গত শতকের ষাটের দশকে পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার এলাকার মিষ্টির দোকানগুলোতে নিসেস্তার হালুয়া খুব জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে ঢাকার কিশোরেরা এসব দোকানের সামনে ভিড় করত হালুয়া ও সন্দেশের জন্য। তখন দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে মিষ্টি খাওয়ার চল ছিল।
আগের দিনের ঢাকায় মুসলিম নারীরা শবে বরাতে তাঁদের বাড়িতে নানা রকমের হালুয়া তৈরি করতেন। হাকীম তাঁর বইতে অনেক রকম হালুয়ার উল্লেখ করেছেন। এর মধ্য রয়েছে পেস্তার হলুয়া, ডিমের হালুয়া ইত্যাদি। ‘সোহান হালুয়া’ বলেও এক রকমের হালুয়ার কথা তিনি বলেছেন, যা পেস্তা বাদাম ও কিশমিশ দিয়ে তৈরি করা হতো। গম জ্বাল দিয়ে মজ্জা বের করা হতো। যাকে বলা হতো ‘সিমনাক’। এই সিমনাক প্রয়োগ করা হতো হালুয়ার সঙ্গে বিশেষ মাত্রায়। এসব এখন আর হয় না। হালুয়ার এমন বনেদি ঐতিহ্য হাকীমের আমলেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এসেছিল। তাই আক্ষেপের স্বরে তিনি বলেছেন, ‘সেই সব বেগমগণ বিদায় নিয়েছেন, যাদের শবে বরাতের হালুয়া বানানোর ব্যাপারে পরিপূর্ণতা ও নৈপুণ্য ছিল এবং হরেক রকমের হালুয়া তারা বানাতেন।’
সুজির হালুয়া থেকে আরেকটি মিষ্টি তৈরি হয়, সেটি অবশ্য খুব জনপ্রিয়। তার নাম মোহন ভোগ। হাকীম হাবীবুর রহমান লিখেছেন, ‘সুজির হালুয়া যাকে মোহনভোগ বলা হয়, সব বাড়িতেই এই সব সময়েই তৈরি হয়ে থাকে।’
সঙ্গনিরোধের এই সময়ে প্রতিবেশীকে পাঠাতে না পারলেও পরিবার নিয়ে শবে বরাতের আহার পর্বটি জমে উঠতে পারে অনায়েসে।