‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে,—/ হেমন্তের মাঠে–মাঠে ঝরে/ শুধু শিশিরের জল;/ অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/ হিম হয়ে আসে/ বাঁশ–পাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা!/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!/ ধানক্ষেতে—মাঠে/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা!’
হেমন্ত এক অদ্ভুত ঋতু। আশা জাগানো ঋতুও বটে। জীবনানন্দের কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে কার্তিক আর অগ্রহায়ণ। এসেছে হেমন্ত নানা রূপে। এই ঋতু মানুষকে শতাব্দীর পর শতাব্দী সুখের মুখ দেখিয়েছে। আজও দেখিয়ে চলেছে। আগের মতো এখন আর কেবল হেমন্তে ফসল না উঠলেও কার্তিক আর অগ্রহায়ণ আছে স্বমহিমায়।
এখনো দেশে দেশে ফসল তোলার উৎসব হয়। বাংলার ঘরে ঘরে হেমন্ত আমোদিত করে নবান্নের আঘ্রাণে। হেমন্তের ফুল্লতা, আনন্দ–প্লাবন ছড়িয়ে যায় শীতেও। অনেক দেশে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় পৌষেও।
এই অবসরে তাই দেখে নেওয়া যেতে পারে এশিয়ার কিছু দেশের ফসল তোলার উৎসবের স্বরূপ।
দক্ষিণ এশিয়া
দক্ষিণ এশিয়ার প্রসঙ্গে সবার আগে ভারতের উৎসবগুলোর কথা চলে আসে। সেখানে প্রদেশভেদে রয়েছে অনেক উৎসব। পশ্চিমবঙ্গে নবান্ন তো আছেই, অন্য প্রদেশগুলোতেও অনুষ্ঠিত হয় তাদের মতো করে ফসল তোলার উৎসব। যেমন পাঞ্জাবের উৎসব হলো লহরি। আখ, গম ইত্যাদি তাদের প্রধান ফসল। তাই তারা আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশ ঘিরে নাচে, গান গায়। চলে খাওয়াদাওয়া। ভারতের মতো পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরাও লগিরি উদ্যাপন করে থাকে।
অন্যদিকে শীতে আসাম মেতে ওঠে তাদের নবান্নে। ওরা বলে ভোগালি বিহু বা মাঘ বিহু। জানুয়ারি মাসেই এই উৎসব হয় গোটা আসামে। বিভিন্ন সম্প্রদায় অংশ নেয় এই উৎসবে। তারা পরে তাদের নিজস্ব উৎসব পোশাক। নাচ–গান তো হয়ই, সঙ্গে থাকে খানাপিনা। উদ্যাপনকে আরও উপভোগ্য করতে আয়োজন করা হয় ষাঁড়ের লড়াই, পাখির লড়াই। এই উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ সুঙ্গা পিঠা, তিল পিঠা, নাড়ু ইত্যাদি। এই বিহু আসরে মাঘ মাসে হয় বলে একে মাঘ বিহুও বলে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের গারো সম্প্রদায় নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে উদ্যাপন করে ওয়ানগালা। চরাচর উচ্ছল হয়ে ওঠে ঢোলের শব্দে। সঙ্গে চলে নাচ ও গান। মেঘালয় আর আসামের গারো সম্প্রদায় এই উৎসব করে।
ওডিশায় এই উৎসবই আবার পরিচিত নুয়াখাই নামে। নুয়া মানে নতুন আর খাই মানে অন্ন। অর্থাৎ, নবান্ন। এই উৎসবের মূল আকর্ষণ নানা স্বাদের পিঠা। ওডিশায় এই উৎসব হয় আগস্টের শেষ সপ্তাহে।
দক্ষিণ ভারতেও রয়েছে এলাকা, সম্প্রদায় বা প্রদেশভেদে একাধিক উৎসব। কেরালায় ২২ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর, ১০ দিন ধরে উদ্যাপিত হয় ওনাম উৎসব। এই মালয়ালি সম্প্রদায়ের মানুষ উৎসব উপলক্ষে ঘরদোর সাজায়। আলপনা আঁকে, নতুন কাপড়চোপড় পরে। আর খাওয়াদাওয়া তো আছেই। রাসাম, পায়াসাম, আভিয়াল, লাল চালের ভাত আর পারিপ্পু কারি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। উৎসবে মাত্রা আনতে নৌকাবাইচ আর বাঘ নৃত্যের আয়োজন করা হয়।
তামিল সম্প্রদায়ের নবান্নকে বলা হয় পোঙ্গল। জানুয়ারির ১৫-১৮, এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তামিলনাড়ুতে। প্রথম দিন অনুষ্ঠিত হয় ভোগী উৎসব। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের জন্য ইন্দ্রের পূজা করা হয়। দ্বিতীয় দিন নতুন ধানের চাল আর দুধ দিয়ে রান্না পায়েসে ভোগ দেওয়া হয় সূর্যদেবতাকে। তৃতীয় দিনে গবাদিপশুর পূজা আর চতুর্থ দিনে ঐতিহ্যবাহী পোঙ্গল অনুষ্ঠিত হয়। লাল চালের ভাত, হলুদ, পান আর সুপারি দিয়ে পূজা করা হয়। এই উৎসবে বাড়িঘর সাজানো হয়। আলপনা করা হয়। ধান মাড়াইয়ের পর পড়ে থাকা খড় দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করা হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
এবার তাকানো যাক দূরপ্রাচ্যের দিকে। ইন্দোনেশিয়ার শস্য ও উর্বরতার দেবী হলেন দেবী শ্রী। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের হিন্দুধর্মাবলম্বীরাই মূলত এই পূজা এবং উৎসব করে তাদের শস্য ওঠা উপলক্ষে। এই উৎসব চলে এক মাস ধরে।
চীন, তাইওয়ান আর ভিয়েতনামের ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো চন্দ্র উৎসব। অষ্টম চন্দ্র মাসের পূর্ণিমা রাতেই শুরু হয় অনুষ্ঠান। যেটা মাঝ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের শুরুর মধ্যে পড়ে। লণ্ঠন প্রজ্বলিত করা হয়ে থাকে এই উৎসব উপলক্ষে। বলা হয়, এই আলোয় সমৃদ্ধ আর আলোকিত হবে সবার জীবন। আর মুন কেক হলো এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। পদ্ম ফুলের বীজ, নানা ধরনের বীজ দিয়ে এই কেক তৈরি হয়। এই কেক হলো পারিবারিক মিলনের প্রতীক। এ ছাড়া থাকে নানা ধরনের খাবারের বিপুল আয়োজন। খাওয়াদাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ধরনে খেলা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এই উৎসব উপলক্ষে।
কোরিয়ায় এই উৎসবকে বলা হয় চুসিওক। আর জাপানে বলে সুকিমি। উভয় দেশেই ফসল তোলার এই উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে অনুষ্ঠান আর খাওয়াদাওয়া। ঐতিহ্য অনুসরণ করে সমৃদ্ধির প্রার্থনা করা হয়।
পাপুয়া নিউগিনিতে অনুষ্ঠিত হয় ওল উৎসব। ওদের দেশে ওল তোলার সময় তারা এই উৎসব করে থাকে।
সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার তামিলরাও পোঙ্গল উৎসব করে থাকে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া আর ফিলিপাইনেও নবান্ন বা তাদের শস্য ওঠার উৎসব পালন করে থাকে। ফিলিপাইনে পালিত হয় তিনাগবা উৎসব।
কম্বোডিয়াতে পূর্ণিমা আর জলখেলা উৎসবের মধ্য দিয়েই শস্য তোলা উৎসব পালন করে থাকে।
ভিয়েতনামে শস্য তোলা উৎসব পরিচিত ত্রুং থু নামে। এটাকে মধ্য হেমন্ত উৎসবও বলে। এই উৎসব উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের হয়। এ জন্য তৈরি করা হয় মুখোশ, ড্রাগন, বাতি। চলে নাচ ও গান।
মিয়ানমারের ফসল তোলা উৎসবকে বলা হয় হতামানে পিউ। প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মিলিত হয় খেতের ফসল নিয়ে। সেখানে শস্যদানা থেকে ফলমূল সবই থাকে। আর এসব দিয়ে তৈরি হয় পায়েস–সদৃশ আঠালো খাবার; যা সবার আগে উৎসর্গ করা হয় ভগবান বুদ্ধকে।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ন্যাটজিও