ইচ্ছা ছিল সাগরে গিয়ে ইলিশ মাছ ধরা নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতা নেওয়া; কিন্তু কোনো মাঝিমাল্লাকে রাজি করাতে না পেরে তা এত দিন হয়ে ওঠেনি। তবে কোরবানির ঈদের ছুটিতে সে সুযোগ কাজে লাগাই চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের নিজস্ব প্রতিবেদক ইমরান বিন ছবুরের সহায়তায়। ইমরানের বাড়ি একেবারে সাগর–সংলগ্ন বেড়িবাঁধের পাশে। তিনি তিন দিনের চেষ্টায় একটি নৌকার মাঝিকে রাজি করান আমাদের সাগরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমরা সাগরে যাই গত ৫ আগস্ট। আগের রাতে ইমরান জানান, নৌকার মালিকের পরামর্শে একটি নৌকার মাঝির সঙ্গে কথা হয়েছে। সকাল সাতটায় নৌকায় উঠতে হবে। নিতে হবে থ্রি–কোয়ার্টার প্যান্ট, ফুল হাতার গোল গলা টি-শার্ট ইত্যাদি। আমিও রাতে প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। কথা হয় মাঝিদের সঙ্গে। সাগরে যাব আমি, ইমরান ও বাংলা চ্যানেল বিজয়ী সাঁতারু জামশেদুল আলম। কিছুটা রোমাঞ্চে রাতে ঘুম কম হয়। ঢেউ, রোদ আর আবহাওয়া কী রকম আচরণ করে, তা নিয়ে চলে ভাবনার দোলাচল।
যথারীতি ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে আনোয়ারা উপজেলার কালাবিবির দীঘির মোড়ে যাই। সেখান থেকে জামশেদকে মোটরসাইকেলে তুলে ২০ কিলোমিটার দূরে সাগর উপকূলের দিকে ছুটি। সকাল সোয়া ছয়টার সময় আমরা উপকূলের সাত্তার মাঝির ঘাটে পৌঁছাই। সেখানে আমরা হালকা নাশতা সেরে নিই। নৌকায় বমি হতে পারে, এই ভয়ে বেশি কিছু না খেয়ে কিছু আচার ও পানি নিয়ে ঠিক সাতটার সময় নৌকায় উঠি।আমাদের নৌকার মাঝি জালাল উদ্দিনসহ পাঁচজনের সঙ্গে আমাদের তিনজন, এই মোট আটজন সওয়ারি নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। এর আগে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয় জাল তোলার সময় কিংবা ঢেউ এলে কীভাবে বসব আমরা।
নৌকা ছাড়ার ২০ মিনিট পর, ততক্ষণে প্রায় আড়াই কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছি, এই সময়ে মাঝি একটি জালের কাছাকাছি গিয়ে নৌকার গতি কমান। তখন একজন পানিতে হুক মেরে জালের একটি রশি টান দেন। সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা রশিসমেত জাল নৌকার সামনের দিক থেকে টেনে তুলে নেন। জালটা মাঝিমাল্লারা নৌকার একপাশ থেকে তুলে জালে আটকে থাকা মাছ ও ময়লা নৌকায় রেখে আরেক পাশে ফেলে দিচ্ছিলেন। ওই সময় যে পাশ থেকে জাল টানা হচ্ছিল, সে পাশে কাত হয়ে যায় নৌকা। ১০০ মিটার লম্বা ওই জাল থেকে ১০টির মতো ছোট–বড় ইলিশ পাওয়া যায়।
মাঝিমাল্লারা জানান, জাল তোলা আর মাছ নৌকায় রাখার মুহূর্তটা খুব বিপজ্জনক। ওই সময় সাগর উত্তাল থাকলে কিংবা ঢেউয়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। কারণ, তখন নৌকাটি কাত হয়ে যায়।
আমাদের নৌকাটি এভাবে একটা একটা করে জাল তুলে গভীর সাগরের দিকে যেতে থাকে। একটা জালের সঙ্গে আরেকটা জালের দূরত্ব তিন শ থেকে চার শ মিটার। একপর্যায়ে দেখি, সাগরের কিছু জাহাজ দেখা গেলেও উপকূল আর খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। ওই সময় মনে ভয় জাগে। তারপরও সাধ্যমতো ছবি আর ভিডিও করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। হঠাৎ দেখি, জালে আটকে থাকা জীবন্ত ইলিশ আর লটিয়া মাছ। মাঝিরা জাল থেকে জীবন্ত মাছগুলো আমাদের সামনে এনে দেন। আমরা নৌকার পেছনে বসে সতর্কভাবে এগুলোর ভিডিও করি। জীবন্ত ইলিশ আর লটিয়া মাছ দেখে মন খুশিতে ভরে ওঠে।
এভাবে একে একে ১৫টির মতো জাল থেকে মাছ নিয়ে উপকূলের দিকে ছোটে আমাদের নৌকা। সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ১০টার সময় আমরা উপকূলে ভিড়তেই আমাদের নৌকা ঘিরে ধরেন ক্রেতারা। তখন নৌকার মাল্লারা মাছের টুকরি নিয়ে নিয়ে নিচে নামেন মাছ বিক্রির জন্য। আমাদের নৌকায় সেদিন মাছ পাওয়া যায় ৩০ কেজির মতো। এই মাছ নিলামে বিক্রি হয়। ততক্ষণে সৈকত ক্রেতা আর বিক্রেতায় গমগম করছে। সাগর থেকে মাছ নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে নৌকাগুলো। আমাদের নৌকার মাঝি জানান, আমরা উপকূল থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম।
মাছের ব্যবসায়ী আর জেলেরা জানিয়েছেন, জেলেরা ভাসা জাল আর টং জাল বসান সাগরে। এসব জালের মধ্যে কিছু নৌকা সাগরে দুই সপ্তাহ ধরে মাছ শিকার করে উপকূলে ফেরে। আর কিছু নৌকা উপকূলের কাছাকাছি থেকে দিনে দুই থেকে চারবার মাছ শিকার করে নিয়ে আসে কূলে। সাগরে জাল পাতা থাকে আগে থেকে। প্রতিটি নৌকায় ৫ থেকে ১৪ জন মাঝিমাল্লা কাজ করেন।
আনোয়ারা উপজেলা মৎস্য কার্যালয় জানায়, আনোয়ারা উপকূলের বিভিন্ন ঘাটে ৬৬৪টি মাছ ধরার নৌকা আছে। এর মধ্যে ফকিরহাট ঘাটে ১৭০টি, উঠান মাঝির ঘাটে ২৮০টি, গলাকাটা ঘাটে ৩৫টি, সাত্তার মাঝির ঘাটে ৪৫টি, পিচের মাথায় ৩৫টি ও বাছা মাঝির ঘাটে ৪০টি নৌকা আছে। এর বাইরে পারকি ও জুঁইদণ্ডি এলাকা থেকে সাগরে যায় অন্যান্য নৌকা। আর এসব নৌকায় কাজ করেন আনোয়ারা উপকূলের ১০ হাজারের বেশি মৎস্যজীবী।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নির্বিঘ্নে প্রজনন নিশ্চিত করা এবং ছোট মাছকে বড় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে ২০ মে থেকে ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে মৎস্য বিভাগ। ওই নিষেধাজ্ঞা শেষে ২৪ জুলাই থেকে সাগরে নামেন জেলেরা। প্রথম প্রথম আশানুরূপ ইলিশ ধরা না পড়লেও এখন ইলিশ ধরা পড়ছে ব্যাপক হারে।
কামাল উদ্দিন নামের এক নৌকার মালিক বলেন, ‘দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর ইলিশের আশায় ধারদেনা করে মাছের ব্যবসা শুরু করি আমরা। কিন্তু প্রথম দুই সপ্তাহে বেশি পরিমাণ ইলিশের দেখা না পেলেও আমরা এখন প্রচুর ইলিশ পাচ্ছি।’
তবে বার আউলিয়া এলাকার ব্যবসায়ী মো. কাইয়ুম বলেন, ‘আমি চার লাখ টাকা খরচ করে সাগরে নৌকা নামিয়েছি। আশা করি ভালো মাছ পাব।’
রায়পুর ইউনিয়ন মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আবদুচ সোবহান বলেন, আনোয়ারায় এবার প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। মাছের আকারও বড়।
আনোয়ারার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা রাশিদুল হক জানান, আনোয়ারা উপকূল এখন উৎসবমুখর। দেদারসে চলছে মাছ শিকার চলছে। মাছের সাইজ বড় হওয়ায় জেলেরাও ভালো দাম পাচ্ছেন।