ওয়াফল যেভাবে রেস্তোরাঁর অভিজাত খাবার থেকে জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড হয়ে উঠল
আগেও ঢাকার কয়েকটি রেস্তোরাঁর মেনুতে ওয়াফল ছিল। অনেকে খেতও, তবে বেশির ভাগই এড়িয়ে যেত। কারণ, মূল মেনুর পর শেষ পাতে ডেজার্ট হিসেবে প্লেটে পরিবেশন করা হতো ওয়াফল। এটা খাওয়ার জন্য আলাদা একটা আয়োজন লাগত। কিন্তু মেনুতে শুধু ওয়াফল রেখে যে–ই দোকান খোলা হলো, ঢাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল ওয়াফল। প্রথমে যিনি সাহস করে এই দোকান খুলেছিলেন, তাঁকে একটা স্যাল্যুট দিতেই হয়। তাঁকে অনুসরণ করেই এখন মূল সড়ক থেকে অলিতে –গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে ওয়াফলের দোকান।
আলাদাভাবে কিছু করার চিন্তা থেকেই বনানীতে ‘ওয়াফেল আপ লিমিটেড’ নামের দোকানটি খোলা হয়েছিল, জানালেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ সালমান। করোনা–পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে গরম–গরম ওয়াফল পরিবেশন করা শুরু করে ওয়াফল আপ লিমিটেড। মোহাম্মদ সালমান বলেন, দাম কম, কাঠি আটকানো থাকার কারণে কাঁটা চামচ-ছুরি ব্যবহার করতে হচ্ছে না, গরম ও মুচমুচে অবস্থায় বাক্সেই পাওয়া যাচ্ছে, মধু বা চকলেট সিরাপের বদলে দেওয়া হচ্ছে নানা রকম ফল, আইসক্রিম, জ্যাম—এসব কারণে ঢাকায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওয়াফল।
ওয়াফল যে আইসক্রিমের লাঠির মধ্যে ঢুকিয়ে খাওয়া যায়, এ ভাবনাই সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা চমক তৈরি করে। প্যাকেটে করে হাঁটতে হাঁটতে, রিকশা বা গাড়িতে চেপে ওয়াফল খাওয়া জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এভাবে এসি রেস্তোরাঁর অভিজাত খাবার থেকে দ্রুত স্ট্রিট ফুডে হয়ে ওঠে ওয়াফল।
রকমারি ওয়াফল পাশ্চাত্যে সকালের নাশতা হিসেবেই জনপ্রিয় ওয়াফল। বিশেষ করে শিশুদের নাশতায়। আমাদের দেশে এটি এখন রাতের ডেজার্ট হিসেবেও খাওয়া হচ্ছে। রেসিপি খুব সহজ। ময়দা, ডিম, দুধ, বেকিং পাউডার, চিনি, লবণ, মাখন, ভ্যানিলা এসেন্স মিশিয়ে নিলেই হলো। অনেকে দইও দেন। ওয়াফল বানানোর মূল উপকরণ কম–বেশি কাছাকাছি। বানানোর পর কীভাবে এটা পরিবেশন করা হবে, সেটার ওপরই এখন প্রতিযোগিতা চলছে।
চার কোনা, গোল, হৃদয় আকারে অথবা কাঠির মধ্যে গেঁথে লম্বা আকারে বানানো হচ্ছে ওয়াফল। ওপরে নানা ধরনের সিরাপ-চকলেট, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, হুইপড ক্রিম, আইসক্রিম—বাদ রাখা হচ্ছে না কিছুই। দামটাও নাগালের মধ্যে—৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। ঢাকায় ওয়াফলের ওপর নিউটেলার ব্যবহারই বেশি জনপ্রিয়।
দোকানের মেনু কার্ডের নামগুলো দেখলেই সেটা বোঝা যায়—চকো নিউটেলা, হুপি নিউটেলা, ডেথ বাই নিউটেলা, ক্যারামেলাইজড নিউটেলা, নিউটেলা চকো উইথ আইসক্রিম, নিউটেলা চকো চিপস, মাইটি নিউটেলা, নিউটেলা অ্যান্ড নাটস, নিউটেলা অ্যান্ড চকো পাউডার, নিউটেলা ওভারলোড, নিউটেলা আইস লাইট, নিউটেলা আইস লোডেড, প্রিমিয়াম নিউটেলা ইত্যাদি। প্রতিটি ওয়াফলের দোকানে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, নিউটেলা ওয়াফল থাকবেই। পাশাপাশি পাবেন স্ট্রবেরি ওয়াফল, রেড ভেলভেট ওয়াফল, ফ্রুটি ব্লিস, ভেরি ভেরি স্ট্রবেরি, বানানাটেলা ওয়াফল, কুকিজ অ্যান্ড ক্রিম চিজ, প্রিমিয়াম ব্লুবেরি, অরিও আইস চকো চিপস, চকলেট আইস নাট, ডার্ক চকো ওয়াফল, ব্যানানা ব্লাস্ট, ব্রাউনি চকলেট চিপস ইত্যাদি।
ওয়াফল আপের প্রতিটি উপকরণ নিয়ে আসা হয় দেশের বাইরে থেকে। মূল উদ্যোক্তা যিনি, সেই মোহাম্মদ সালমান ছাড়া এই রেসিপি কেউ জানেন না। সালমান বলেন, ‘ওয়াফল আপের ওয়াফলগুলো যেন মচমচে থাকে, সেটার জন্য বেশ কয়েক মাস ধরে কাজ করেছি। রেসিপি আমিই বের করেছি। আমাদের কোনো শেফ এটার রেসিপি জানেন না। কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডসের মতো বলতে পারেন অনেকটা সিক্রেট রেসিপি। সবকিছু ফ্যাক্টরি থেকে তৈরি হয়ে আসে। অর্ডার পেলে গ্রাহকদের জন্য বানিয়ে দেওয়া হয় তৎক্ষণাৎ। গ্রাহকদের জন্য ওয়াফল আপের দোকান খোলা থাকে রাত তিনটা পর্যন্ত, বাড়ি থেকে বসে অর্ডার দিলে সারা রাতই ডেলিভারি পাবেন।’ অনলাইনে ওয়াফল ডেলিভারি সেবা বিশ্বের অনেক জায়গাতেই নেই, জানালেন সালমান। কারণ, বাক্সে করে পাঠাতে পাঠাতে খাবারটি নরম হয়ে যায়।
যুগে যুগে ওয়াফল এত সব স্বাদের মধ্যে ম্যাপল সিরাপ আর আইসিং সুগার দিয়ে বানানো ওয়াফলই বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো ডেজার্টগুলোর একটি হলো এই ওয়াফল। ধারণা করা হয়, প্রাচীন গ্রিস থেকে ওয়াফল এসেছে। অনেক জায়গায় আবার দেখা গেল, চার হাজার বছর আগে নিওলিথিক বা প্রস্তর যুগেও ওয়াফলের চল ছিল। মধ্যযুগীয় ইউরোপে কৃষক থেকে রাজা পর্যন্ত সমাজের সব অংশই ওয়াফল খেত। লম্বা হাতলওয়ালা লোহার প্লেটের মধ্যে খোলা আগুনে এটা রান্না করা হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোহার প্লেটগুলোর গভীরতা বাড়তে থাকে। ওয়াফলের বিবর্তনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে সম্ভবত নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়াম।
ডাচরা ওয়াফলকে গোল আকার থেকে বের করে এনে চার কোনা আকারে বানানো শুরু করে। ১৬২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসে ডাচ ওয়াফল। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরই পুরো দুনিয়ায় পরিচিতি লাভ করে ওয়াফল। ১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম লম্বা হাতলওয়ালা ওয়াফল মেকার বানান টমাস জেফারসন। প্রায় ৮০ বছর পর ১৮৬৯ সালের ২৪ আগস্ট কর্নেলিয়াস সোয়ার্টআউট নামের একজন ডাচ-আমেরিকান প্রথম ওয়াফল আয়রনের পেটেন্ট পান। এদিনই জাতীয় ওয়াফল দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ঢাকায় আছে, আছে অন্য শহরেও ঢাকায় ওয়াফলের দোকান বা খাবার জায়গাগুলোর সাজসজ্জা অনেক রঙিন। অনেকটা রেট্রো স্টাইল। অনেক দোকানে ওয়াফল ছাড়াও বিক্রি হয় বার্গার, স্যান্ডউইচ, জুস। যাঁরা মিষ্টিমুখ করতে চান না, তাঁদের জন্য কোনো কোনো দোকানে মিষ্টি ওয়াফলের পাশাপাশি আছে ঝাল ওয়াফল, চিকেন ওয়াফল, চিজ ওয়াফল।
ঢাকা ছাড়াও বর্তমানে চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটে ওয়াফলের অনেক দোকান খোলা হয়েছে। ধানমন্ডি, পুরান ঢাকা, উত্তরা, গুলশান, নিকুঞ্জ, বনশ্রী, খিলগাঁও ও মোহাম্মদপুরেই আছে ওয়াফল আপ, ওয়াফলওয়ালা, ওয়াফল বস, ওয়াফল ম্যানিয়া, ওয়াফল গ্যাং, ওয়া ওয়া ওয়াফলস, ওয়াফল স্ট্রিট, দ্য ওয়াফল হাউস, ওয়াফল গো, ওহ ওয়াফলস, ওয়াফল পপস। আমাদের দেশে কোনো খাবার নিয়ে যখন ফুড ভ্লগ করার ধুম পড়ে, বুঝবেন সেই খাবারের গ্রাহক বেড়েছে। দেশি টিকটকার ও ফুড ভ্লগে ঢুঁ মারলেই দেখবেন ওয়াফলের রমরমা। মোহাম্মদ সালমান জানালেন মজার একটি তথ্য। ওজন বাড়ার ভয়ে যাঁরা ওয়াফল খান না, তাঁরাও চিট ডেতে এসে ওয়াফল খেয়ে যান। ট্রেন্ড দেখে মনে হচ্ছে, ওয়াফলের আবেদন শিগগিরই ফুরাবে না। অন্তত আরও কয়েক বছর।