ছাদের ওপর মাটির ঘর!

প্রথম দেখায় মনে হবে অ্যান্টার্কটিকার বাড়িঘর। বরফের ওপর এস্কিমোরা যেভাবে ইগলু বানিয়ে বসবাস করে, আদলটা ঠিক সে রকম। আদতে এটা একটা রেস্তোরাঁ, নাম লা টিং টিং। নকশার কারণেই তরুণদের কাছে হয়ে উঠেছে দারুণ এক হ্যাংআউট। ফাল্গুনের এক দুপুরে দেখে এসেছেন হাসান ইমাম

উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ রোড ধরে এগিয়ে খালপাড় এলাকায় গেলেই ডানে চোখে পড়বে রূপায়ন সিটি। এ সিটির পাশেই পথের ধারে লম্বা একটা নার্সারি লাগোয়া দোতলা মার্কেট। এ মার্কেটের ছাদের ওপরেই গড়ে উঠেছে লা টিং টিং রেস্তোরাঁ।
ছবি: সুমন ইউসুফ

লা টিং টিং নামকরণের কারণ কী? প্রশ্ন রাখলাম রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী সোহরাব হোসেনের কাছে। প্রশ্ন শুনে মুখ বন্ধ করে চওড়া একটা হাসি দিলেন তিনি, ‘এটা তেমন কিছু নয়। “লা” শব্দটা নিয়েছি স্প্যানিশ থেকে আর “টিং টিং” চাকমা শব্দ। “লা” মানে তো ইংরেজি “দ্য” আর “টিং টিং” অর্থ “ভরপেট”। এ–ই আরকি!’

উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ রোড ধরে এগিয়ে খালপাড় এলাকায় গেলেই ডানে চোখে পড়বে রূপায়ন সিটি। এ সিটির পাশেই পথের ধারে লম্বা একটা নার্সারি লাগোয়া দোতলা মার্কেট। এ মার্কেটের ছাদের ওপরেই গড়ে উঠেছে লা টিং টিং রেস্তোরাঁ। 

খানিকটা ডিমের আকৃতির ঘরগুলো একবার দেখলে যে কাউকেই টানবে। আর প্রবেশেও কোনো বাধা নেই। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার মুখেই কয়েকটি চিত্রকর্ম। জয়নুল, কিবরিয়া, শাহাবুদ্দিনের আঁকা। সেসব দেখতে দেখতে ছাদে উঠে এলেই লম্বা শিকলে জড়ানো বিশাল একটা ঘণ্টি। ডানে কচ্ছপাকৃতির একটা চুলা। সোহরাব হোসেন জানান, কাঠের আগুনে তৈরি পিৎজার স্বাদ দিতেই চুলাটা বানানো হয়েছে, তবে চুলায় তৈরি পিৎজা কারিগরের অভাবে সেটা আপাতত বন্ধ।

লা টিং টিংয়ের খাবার
ছবি: সুমন ইউসুফ

ছাদের ওপর মোট ৬০০ বর্গফুটজুড়ে এ রেস্তোরাঁ। আছে চারটি মাটির ঘর, তিন পাশে তিনটি কাঠের ঘর। আর এক পাশে কিচেন এরিয়া। এ ঘরের আদল আবার ভিন্ন, উপকরণও আলাদা—লাল ইট।

মাটির ঘরগুলোর ছাউনিতে ব্যবহার করা হয়েছে শণ। সোহরাব হোসেন বলেন, ‘২০২০ সালে যখন এ রেস্তোরাঁর কাজ শুরু করি, তখনই দেশে এল করোনা। যেহেতু নিজের পরিকল্পনাতেই পুরো রেস্তোরাঁ বানাতে চেয়েছি, অনেক কিছুই তাই ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়েছে।’

রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী সোহরাব হোসেন
ছবি: সুমন ইউসুফ

এই যেমন শুরুতে মাটির ঘর বানানোর লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন আশপাশে কয়েকজনকে ডেকে এনে কী করতে চাইছেন বোঝালেন। তারপর তাঁদের দিয়েই একটা বাঁশের কাঠামো দাঁড় করালেন। এরপর আরেক দলকে বুঝিয়ে তৈরি করে নিলেন মাটির দেয়াল। সবশেষে আরেকটা দল ঘরের ওপরের শণের চাল তৈরি করে দিল। ঘর পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর কয়েক দিন বৃষ্টির পানি লেগে গলে গলে পড়ে গেল। খানিকটা হতাশা নিয়ে আবার কাজে হাত দিলেন সোহরাব হোসেন। কীভাবে ঘর টিকিয়ে রাখা যাবে, সে উপায় খুঁজতে লাগলেন।

সোহরাব হোসেন বলেন, ‘গ্রামে মাটির ঘর যেহেতু মাটির ওপরেই তৈরি করা হয়, তাই সেটার ভিত ঠিক রাখা সহজ হয়। কিন্তু কংক্রিটের ছাদের ওপর এ ধরনের ঘর বানানো কিছুটা কঠিন। এবার তাই মাটির কাঠামোর ওপরের অংশে আলাদা করে সিমেন্টের একটা প্রলেপ দিলাম। রঙের প্রতিষ্ঠান বার্জারে কথা বলে মাটির মতো একটা রং তৈরি করে এনে সেটা দিলাম শেষে।’

ভেতরের পরিবেশটা বেশ সুন্দর
ছবি: সুমন ইউসুফ

ঘরের নিচের দিকে ব্যবহার করা হয়েছে পুরোনো কিছু ইটের টুকরা। কাঠের ফ্রেমের ওপর চওড়া কাচের পাল্লা দেওয়া জানালা আছে একাধিক। আর পুরো ঘরের দেয়ালজুড়ে আছে অনেক কাচের বোতল, যেসব বোতলের আলো দিনের বেলা দারুণ এক পরিবেশ তৈরি করে। শণের এ ঘরগুলোয় এয়ারকুলার থাকলেও বিশেষ দরকার পড়ে না। ফাল্গুনের এক দুপুরে গিয়েও আমরা সেখানে পেলাম ঠান্ডা পরিবেশ। প্রতিষ্ঠানটির অন্দরভাবনা যাঁর, সেই সোহরাব জানান, মাটির ঘর এমনিতেই শীতল থাকে; আর ওপরে যেহেতু শণের ছাউনি, তাই ঘর থাকে ঠান্ডা।

বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে থাকলে বদলে যায় পরিবেশ। বাইরের আলোর বদলে ঘরের ভেতরে বাঁশের তৈরি ল্যাম্পশেড জ্বলে ওঠে। সৃষ্টি হয় আরেক রকম আবহ। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই রেস্তোরাঁ, মেলে নানা স্বাদের খাবার। কন্টিনেন্টাল, দেশি ও চায়নিজ মেনু থেকে ফরমাশ দিলে তারপর তৈরি হয় খাবার।

গাজীপুর, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো দেশের নানা প্রান্ত থেকে কাঠখড় জোগাড় করে তৈরি হয়েছে উত্তরার এই মাটির ঘর। সদ্য চালু হওয়ার মেট্রোরেলের শেষ স্টেশন থেকে হাঁটা দূরত্বেই এ রেস্তোরাঁ। তাই কোনো এক ছুটির দিনে ঘুরে আসতে পারেন ভিন্ন ধরনের এ স্থাপনায়।

লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল বসতে প্রকাশিত।