একদিন নাহয় শুধু ‘হাঁস’ই হোক
বাঙালির ঋতু বুঝে খাবার। ছয় ঋতুতে ছয় রকম ফলফলারি, ফসল ওঠে। সেই অনুযায়ী খাবারও হয় ভিন্ন। ফসলের অবাধ ফলন হওয়ার কারণে বাজার পটোল, কাঁকরোলে ভরা। কিন্তু পটোল, কাঁকরোল খাওয়া হয় বর্ষাকালে। সেই কালের পটোল হয় হালের ইয়াম্মি, টেন্ডার জুসি স্টেকের মতো।
একসময় শীতকাল ছাড়া বোয়াল, চিতল, শিং, টাকি, শোল মাছের দেখা মিলত না। একদম শীতকালে শিম দিয়ে রান্না করা জমে যাওয়া মাখো মাখো লাল ঝোলের কথা মনে আছে নিশ্চয়। এখন তো শিম আর বোয়াল দুটোই সারা বছর পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাদের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। লাউয়ের কথাই ধরুন না কেন, সারা বছর সবাই মুখিয়ে থাকত শীতকালে মাখনের মতো গলে যাওয়া নরম লাউয়ের স্বাদ নিতে। নবান্নে কচি লাউ দিয়ে হতো দুধ–লাউ। এখন সারা বছরই বাজারে লাউয়ের দেখা মেলে।
একইভাবে হাঁসও সারা বছরই পাওয়া গেলেও বেশি খাওয়া হয় কিন্তু এখনো শীতেই। এ নিয়ে ভোজনরসিকদের মধ্যে বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত রয়েছে। শীতকালে হাঁসের গায়ে চর্বি জমে। চামড়ার নিচে জমা হওয়া চর্বি হাঁসের স্বাদ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। নধরকান্তি চর্বিওয়ালা তেলতেলে হাঁসগুলো ঝোলে-ঝালে পাতিলে পড়লেই ধামাকাদার একটি শিল্প হয়ে ওঠে। যেটি অন্য ঋতুতে লালিত-পালিত হওয়া রুখাসুখা হাঁসে পাওয়া যায় না, বাংলার আপামর খাদক-গবেষকদেরই এই দাবি। বিজ্ঞানতত্ত্ব মেনে কোনো গবেষণা যেহেতু হয়নি, এটিকে তাই বৈজ্ঞানিক ধ্রুব সত্য হিসেবে ধরে নেওয়াটা ঠিক হবে না।
আরেকটি কারণের কথাও বলা হয়, সেটি হচ্ছে, হাঁস ভীষণ গুরুপাক খাবার। গরমকালে বা ভ্যাপসা গরমের বর্ষাকালে এটি খেলে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। শীতকালে হাঁস খেলে গরম লাগবে না। বরং শীত একটু কম লাগবে। আসলেই ভাই, সব বিয়ের অনুষ্ঠান আর কাচ্চি খাওয়ার ঘটনা যেমন শীতকালে হয়, যাতে জবরজং জরি-চুমকির জামা আর হাজার তারার বাতিতেও গরম না লাগে; তেমনি হাঁসের চর্চাটা সারা বছর ঢিমেতালে চললেও শুধু শীতকালেই সেটা হয়ে ওঠে উৎসব। এই সময় আনাচকানাচে ভ্যান থেকে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেলে চলে হাঁস উৎসব। রাজধানীর উত্তরা, পূর্বাচল, তিন শ ফিট, আগারগাঁওসহ নানা স্থানে হাঁস, চালের আটার রুটি, কলাই রুটি, চিতই পিঠা কিংবা খিচুড়ির ধুম লেগে যায়।
মোটামুটি শহরজুড়েই এক গলি পরপর একটা রান্না করা হাঁসের দোকান আর কলাই রুটি পাওয়া গেলেও অবাক হবেন না। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে প্রতি দুই পোস্ট পরপর পাবেন হাঁস বিকিকিনির অফার। কীভাবে ঘরে পালা হাঁস আপনাকে মসৃণ করে পরিষ্কার করে দেবে, রেডি টু ইট আপনার পাতে এসে পৌঁছাবে—সেসব তথ্য এখন ডালভাত। একবার হাঁস লিখে সার্চ দেবেন কেবল, এরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনি শুধুই হাঁস দেখবেন।
সেদিন শুনলাম ঢাকার একটি নামজাদা রেস্তোরাঁ হাঁসের বুফে চালু করেছে। যা-ই খাবেন, তা-ই হাঁস দিয়ে। এখনো খেয়ে দেখা হয়নি, ইচ্ছা আছে শিগগির ঢুঁ মারার। অনলাইনে সার্চ দিয়ে হাঁসপ্রেমীরা সেই রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারুন।
হাঁস খাওয়াটা অনেকটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালের মতো ঘটনা হয়ে গেছে। হাঁস পরিষ্কারের একটি ভিডিও ইতিমধ্যে ভাইরাল। ওয়াক্স জেল দিয়ে হাঁসের প্রতিটা লোমকূপ পরিষ্কার করা হচ্ছে। যাঁরা এ নিয়ে হায় হায় করছেন, পক্ষে-বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছেন, তাঁদের একটু বলি, এখনো বাংলার গ্রাম দেশে এই ওয়াক্সিং পদ্ধতিতেই হাঁস পরিষ্কার করা হয়। শুধু ওয়াক্স জেলের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় এঁটেল মাটি বা কাদা মাটি। হাঁসের গায়ে কাদা লেপে, সেটি চুলার আগুনে পুড়িয়ে হাঁস পরিষ্কার করা হয় বহু যুগ। কিন্তু আপনাকে হাঁস পরিষ্কার নিয়ে কাদা–ছোড়াছুড়ি করতে হবে না, সুপারশপ থেকে শুরু করে বাজারের দোকানেও এখন হাঁস পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। আপনার কাজ শুধু রান্না করে খাওয়া। তবে রান্না করে খেতে না চাইলে অনলাইন-অফলাইন যেকোনো দোকান থেকে হাঁস খেয়ে জাতকুল রক্ষা করুন। এই শীতে শুধুই হাঁস হোক।
কিন্তু এত তেলঝোল মাখা হাঁসের গল্প করলেও হুমায়ূন আহমেদের আমার আছে জল উপন্যাসের
সাব্বির ভাই রসুনের কোয়া দিয়ে সারা রাত ভাপে রেখে যে স্টিমড হাঁস রান্না করলেন, আমার শুধু সেটা খেতে ইচ্ছা করে। রেসিপিটা মনে আছে?