৫০ বছরে আমার কাছে ছানামুখী তৈরি করা শিখেছে এক-দেড় শ কারিগর
ছানামুখী দেখতে চিনির খুরমার মতো। ভেতরের পুরোটাই দুধের নরম ছানা। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন। সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৫ বছর বয়স থেকে এই ছানামুখী তৈরি করছেন দুলালচন্দ্র পাল। তাঁর হাত ধরেই তৈরি হয়েছে অনেক কারিগর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ষাটোর্ধ্ব এই কারিগরের গল্প শুনেছেন শাহাদৎ হোসেন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মধ্যপাড়া এলাকায় আমাদের বাড়ি। আমার বাবা প্রয়াত ধীরেন্দ্রচন্দ্র পাল ছিলেন মিষ্টি ব্যবসায়ী। শহরের ডাক্তার ফরিদুল হুদা সড়কে বাবার অংশীদারি মিষ্টির ব্যবসা ছিল। তাঁদের প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ‘জলযোগ মিষ্টান্ন ভান্ডার’। ছোটবেলায় দেখতাম দোকান থেকে বাড়ি আসার সময় হাতে করে ছানামুখী নিয়ে আসতেন বাবা। তখন থেকেই ছানামুখীর সঙ্গে পরিচয়। আরেকটু বড় হয়ে দোকানে বসে বসে কারিগরদের মিষ্টি বানানো দেখতাম। অনেক সময় কারিগরের কাজে সহায়তাও করতাম। এভাবেই ছানামুখী তৈরির কাজ শিখে ফেলি।
আমি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। এরপর আর পড়াশোনায় মন টেকেনি। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাবার দোকানে যাওয়া-আসা শুরু করি। কোনো কারণে কারিগর না এলে আমিই ছানামুখী তৈরির কাজে হাত লাগাতাম। প্রথমে খুব যে ভালো হতো, এমন নয়। তবে আস্তে আস্তে খামতিগুলো কাটিয়ে উঠি। কারিগরের কাছ থেকে শিখে নিতাম কীভাবে আরও ভালো ছানামুখী তৈরি করা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছানামুখীর তৈরির কাজে দক্ষতা চলে আসে।
১৯৭৮ সাল। আমার বয়স তখন ১৪ বছর। সে সময় আমাদের জলযোগ মিষ্টান্ন ভান্ডার বিক্রি হয়ে যায়। কেনেন রাখাল মোদক। জলযোগের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘আদর্শ মাতৃভান্ডার’। দোকান হাত বদল হলেও কারিগর হিসেবে আমিই থেকে যাই। আজও এখানেই কাজ করে যাচ্ছি। দোকানের মালিক আমাকে কখনো কারিগর মনে করেননি। সব সময় পরিবারের সদস্য মনে করেছেন। তাঁর সন্তানেরাও শ্রদ্ধার সঙ্গে আমার সঙ্গে কথা বলেন। রাখাল মোদকই আমার বিয়ে করিয়েছেন। এ জন্য ভালো বেতনে অন্য দোকানে চাকরির প্রস্তাব পেয়েও কোনো দিন যাইনি।
প্রায় ৫০ বছর ধরে ছানামুখী তৈরির কাজ করছি। এই মিষ্টি বানাতে বানাতেই যৌবন পার হয়ে গেছে। কতজন যে আমার সঙ্গে এসে কাজ করেছেন, হিসাব নাই। সংখ্যাটা এক-দেড় শ তো হবেই। এই আসতেছেন, শিখতেছেন, অন্য দোকানে চলে যাচ্ছেন। এই ধারা অব্যাহত আছে। এখন তাঁরা কারিগর হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে কাজ করেন।
আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে অরূপ বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ছোট ছেলে সৌরভ মুদিদোকানে কাজ করে। মেয়ে বৃষ্টিকে শহরেই বিয়ে দিয়েছি। আমার সন্তানদের কেউই মিষ্টির দোকানে কাজ করে না। তারা কেউই বাপ-দাদার পেশায় আসার আগ্রহ দেখায় নাই।
মহাদেবের ছানামুখী
আগরতলার শিবনগরের নেতাজি এলাকায় আমাদের আত্মীয়স্বজন আছেন। মাঝেমধ্যে ভারতে বেড়াতে যাই। স্বজনেরা তখন ছানামুখী নিয়ে যেতে বলেন। আমি নিয়ে গিয়ে অল্প অল্প করে ভাগ করে তাঁদের দিই। আগরতলার লোকজন আমাদের মতো ছানামুখী বানাতে পারেন না। তাই আমাকে শেখানোর জন্য বলেন। আমি বলি, শেখালে কি তৈরি করতে পারবে? শিখিয়েও আসছি কয়েকবার। শেখানোর পর যখন তাঁরা ছানামুখী তৈরি করেন, তখন তা মনাক্কার মতো হয়ে যায়। আসলে ছানামুখী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারিগর ছাড়া আমাদের অন্য জেলার কারিগরও তৈরি করতে পারে না।
আগে দুধের স্বল্পতা ছিল। আবার ছানামুখীর চাহিদাও ছিল কম। তাই স্বল্প পরিমাণ ছানামুখী তৈরি করতে হতো। আমার মনে আছে সে সময় এক কেজি ছানামুখীর দাম ছিল ৩২ টাকা। সেটাও তখন অনেক। দাম বেশি হওয়ায় মানুষ এক পোয়া (২৫০ গ্রাম), আধা সের (আধা কেজি) করে কিনত। এক কেজি ছানামুখীর দাম এখন ৭০০ টাকা।
ছোটবেলায় বাপ-দাদার কাছে শুনেছি, ভারতের কাশীধামের মহাদেব পাঁড়ে নামের এক লোক ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসছিলেন। লোকটা মিষ্টি বানাতেন। বর্তমান জেলা শহরের মেড্ডায় তখন শিবরাম মোদকের মিষ্টির দোকান ছিল। মহাদেবকে নিজের দোকানে আশ্রয় দেন তিনি। মহাদেব আসার পর শিবরামের মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মৃত্যুর সময় মিষ্টির দোকানটি মহাদেবকে দিয়ে যান শিবরাম। মহাদেব দুটি মিষ্টি বানাতেন। একটি লেডিকেনি আরেকটি এই ছানামুখী।
এই মহাদেব পাঁড়ের নামেই নাকি আমাদের শহরের মহাদেবপট্টি এলাকা।
ছানা দিয়ে ছানামুখী
এক কেজি ছানামুখী তৈরি করতে প্রায় সাত লিটার দুধ লাগে। প্রথমে গরুর দুধ জ্বাল দিতে হয়। এরপর গরম দুধ ঠান্ডা করে ছানা করে নিতে হয়। ছানা আলাদা করতে টুকরিতে রাখতে হয়, এতে পানি ঝরে যায়। পরে পানি ঝরার জন্য ওই ছানা কাপড়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। এভাবে তিন থেকে চার ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখলে ছানা শক্ত হবে। আমরা অনেক সময় রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখি। এতে ছানা বেশি শক্ত হয়। শক্ত ছানাকে চাকু দিয়ে ছোট ছোট টুকরা করে কাটতে হয়। এরপর চুলায় একটি কড়াই বসিয়ে তাতে পানি, চিনি ও এলাচি দিয়ে ফুটিয়ে শিরা তৈরি করতে হয়। ছানার টুকরাগুলো চিনির শিরায় ছেড়ে নাড়তে হবে। সব শেষে চিনির শিরা থেকে ছানার টুকরাগুলো তুলে একটি বড় পাত্রে রাখতে হবে। ওই পাত্র খোলা জায়গা বা পাখার নিচে রেখে শুকাতে হবে। তৈরি হয়ে গেল ছানামুখী।