ইলিশ নিয়ে লিখতে বসলে কোত্থেকে শুরু করব আর কোথায় শেষ করব, তা–ই নিয়ে ধন্দে পড়তে হয়। ইলিশ যেন আজ বাঙালির জাত্যভিমানের প্রতীক। অথচ ১৭১১ সালে লেখা রামেশ্বর চক্রবর্তীর ‘শিবায়ন’–এর আগে ইলিশ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যই ছিল না। এরও ১১০ বছর বাদে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কাশীর গঙ্গায় ইলিশ পাওয়ার কথা জানা যায়। এরপর ১৮৯৭ সালের ‘কষ্টিপাথর’ নাটকে মেলে ইলিশের উল্লেখ। তার পর থেকে এখন অবধি ইলিশ নিয়ে যা লেখা হয়েছে, আর কোনো মাছ নিয়ে কোনো দেশে এত হয়েছে কি না সন্দেহ। তবে ইলিশ নিয়ে কেবল বাঙালির নয়; বরং অন্যদের আদিখ্যেতা কম নয়। উড়িয়ারা তো বলেই থাকে, ‘মাছ খাইবি ইলিশি, চাকরি করিবি পোলিসি।’ সিন্ধিদের ইলিশপ্রীতিও সাংঘাতিক। তারা কখনোই টুকরা করে ইলিশ রাঁধে না; বরং আস্ত ইলিশ ফ্রাই করে। জামাই এলে আপ্যায়ন করে ইলিশের ডিম দিয়ে। আর অন্ধ্রপ্রদেশের লোকজন এতটাই ইলিশপাগল, তা খাওয়ার জন্য যেকোনো কিছুই বন্ধক রাখতে প্রস্তুত। এমনকি তারা মনে করে, নিজের বিয়ে পর্যন্ত বন্ধক দিয়েও ইলিশ খাওয়া উচিত।
কিন্তু কীভাবে খাওয়া হবে ইলিশ? এ নিয়ে নানা মত আছে বৈকি। সৈয়দ মুজতবা আলী আর বুদ্ধদেব বসু, দুই সাহিত্যিক, যাঁদের উভয়েরই আদি নিবাস এই বাংলা, মনে করেন, যত কম মসলা, ইলিশের ততই স্বাদ। সঙ্গে পুষ্টিগুণও। এদিকে রস আর রসনায় সমান পারদর্শী মুজতবা আলী কোনোভাবেই ইলিশের পাশে মাংসের পদ বরদাশত করতেন না। স্বাদের বিচারে ইলিশের চেয়ে অন্য কোনো পদকে এগিয়ে রাখলে তাঁর সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিতেও পিছপা হতেন না। এই আলী সাহেবের কাছে ইলিশ অমৃতসমান, যদি তাঁকে মাঝ বরাবর ফেড়ে হালকা মসলা মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে সেদ্ধ করা হয়। এই ইলিশ যেমন উপাদেয়, তেমনই স্বাস্থ্যকর। তিনি বলতেন, একা আড়াই থেকে তিন কেজির মাছ খেলেও কিছু হবে না।
অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসুর কাছে পেঁয়াজ, আদা আর আলু ইলিশে পড়ল তো গেল। নিজে বাজার ঠিকঠাক করতে না পারলেও ৬৫ বছরে তিনি লিখে ফেলেন ভোজনশিল্পী বাঙালি নামে রান্নাবান্নার একটি বই। তাঁর বর্ণনায়, রজতবর্ণ মনোহরদর্শন মৎস্যকুলরাজ মহান ইলিশ। যার কিনা কিছুই ফেলা যায় না। আর কীভাবে কাটলে ভালোভাবে রান্না করা যাবে এবং স্বাদ বাড়বে, সেটাও তিনি বলেছেন।
তাঁর ঠিক উল্টো হলো প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি। তিনি আবার ইলিশের স্বাদ খোলতাই করতে আদা আর পেঁয়াজ নিয়ে এক পায়ে খাড়া। ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ গ্রন্থে দেওয়া তাঁর রেসিপিতে দেখা যাচ্ছে, বিলাতি বেগুন বা তেমতি (টমেটো), পেঁয়াজ, দুখানা তেজপাতা, ছয় গ্রাম আদা এবং ধনেশাক। এই মসলায় আসলেই ইলিশের সেই সুঘ্রাণ থাকার কথা নয়। এই ব্যঞ্জন চাখলে বুদ্ধদেব বসু নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেতেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মায় একধরনের প্ল্যাঙ্কটন জন্মায়। এটা আর কোনো নদীতে মেলে না। এই প্ল্যাঙ্কটন খাওয়ার কারণে পদ্মার ইলিশের স্বাদ অন্য সব ইলিশের থেকে আলাদা। তা সত্ত্বেও পদ্মার ইলিশ ভালো, না গঙ্গার—এ নিয়ে আবহমানকালের কাজিয়া যেমন অব্যাহত, তেমনি পদ কোনো বাংলার সেরা, তা নিয়েও কম উতরচাপান চলে না। এ ক্ষেত্রে সাহিত্যিকেরা যেন এক কাঠি সরেস। লীলা মজুমদারের সাফ কথা, কাঁচা ইলিশের ঝোল রাঁধুক তো ঘটিরা! চাপানেও কম যান না আরেক লেখিকা জ্যোৎস্না দত্ত, ‘ঘটিদের উদ্ভাবন দই–ইলিশ। পূর্ববঙ্গে তো দইয়ের চলই নেই।’
তবে ইলিশের আসল স্বাদ পেতে বেশি তাপে ফ্ল্যাশ ফ্রাই করতে হবে। তাহলে ওপরের চামড়া হবে ক্রাস্টি বা মুচমুচে। কিন্তু ভেতরটা থাকবে মোলায়েম। ইলিশে প্রচুর তেল থাকে। সেটা ইলিশ কাটলেই বোঝা যায়। মাংসের খাঁজে খাঁজে তেলের পরত। তাই ডুবো তেলে ভাজা যাবে না। আর অনেকক্ষণ ধরেও ভাজা যাবে না। এ জন্যই তো স্টিমার ঘাটের হাত ধোয়া ইলিশ, নদীর মাঝি বা জেলেদের রান্না করা ইলিশ এত মজাদার।
ইলিশ আসলেই কতটা সুস্বাদু তা পানিখোলা ইলিশ খেলেই মালুম হয়। সামান্য পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, কয়েক ফোঁটা তেল, পরিমাণমতো লবণ আর পানি দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। তারপর একটা শ্লোক বলে শেষ করতে করতেই রান্না শেষ। এটাই পানিখোলা ইলিশ। বিক্রমপুর এলাকার বিশেষ ইলিশব্যঞ্জন। অনন্য ডেলিকেসি।
ইলিশ রান্না সহজ। তবে স্বাদ নির্ভর করে পাকা রাঁধুনির মুনশিয়ানার ওপর। না হলে কাঙ্ক্ষিত স্বাদ মেলে না। আর এমন ইলিশ যিনি রাঁধতে পারেন, তাঁকে সোনা বউ না বলে উপায় কি! কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার অন্তত সেটাই বলেছেন: সোনা নাচে কোনা/বলদ বাজায় ঢোল/সোনার বউ রেঁধে রেখেছে/ইলিশ মাছের ঝোল।
ই ইলিশে আবার ঔপনিবেশিক স্পর্শও যে পড়েনি, তা নয়। হ্যাডক কিংবা ম্যাকরেল যেভাবে স্মোকড করে খাওয়া হয়, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ইলিশকেও সেভাবে খাওয়া শুরু করে। তবে অবশ্যই তারা সেটাকে কাঠ বা খই পুড়িয়ে ধোঁয়া করে মসলা ছাড়া ইলিশ স্মোকড করত সারা রাত। পরে কাঁটা বেছে স্ম্যাশড পটেটো কিংবা ফ্রায়েড পটেটো বা পটেটো চিপসের সঙ্গে খেত। এখন অনেক পরিবারে আগে কাঁটা ছাড়িয়ে পরে স্মোকড করে। আবার একটি সূত্র জানাচ্ছে, ইলিশকে স্মোকড করার কায়দাটা নাকি মগ রাঁধুনিদের কৃতিত্ব। সেটা যেভাবেই হোক, ইলিশের ডেলিকেসিতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। এখানেও এসেছে বাঙালি সংস্করণ। কারণ, স্মোকড করার আগে অনেকেই এখন হালকা করে মসলা মাখিয়ে নিচ্ছে।
যাহোক, বাঙালিজীবন কখনোই কণ্টকবিহীন নয়; বরং কষ্ট করেই কেষ্ট মেলায়। তাই কণ্টকাকীর্ণ ইলিশ যে তাদের কাছে মহার্ঘ এবং মহা কামনার হবে, তাতে আর সন্দেহ কী।