কিশোয়ারের হাতে রুই মাছের ঝোল, খাসির রেজালা ও মুরগির কোরমা

কিশোয়ার চৌধুরী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

খেতে ও খাওয়াতে খুবই ভালোবাসেন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি কামরুল হোসেন চৌধুরী ও লায়লা চৌধুরী দম্পতি। একসঙ্গে চার চুলায় রান্না চড়ানো কামরুল হোসেন চৌধুরীর বাঁ হাতের খেল। তাঁদেরই মেজ কন্যা কিশোয়ার চৌধুরী। নামই যাঁর বিশেষণ, আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার জন্য বিশেষ বিশেষণের তাঁর দরকার পড়ে না।

রান্নার বিশ্বমাতানো প্রতিযোগিতা মাস্টারশেফের অস্ট্রেলিয়া সংস্করণের ১৩তম আসরের শুরু থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন কিশোয়ার। বাঙালি হেঁশেলের তেল–মসলার পদকে উপজীব্য করে যত দিনে তিনি দ্বিতীয় রানারআপ হয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন, তত দিনে তিনি বড় তারকা। একের ভেতর অনেক বলতে যা বোঝায়, এই শেফ যেন ঠিক তা–ই। তিনি পড়াশোনা করেছেন ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও জার্মানির হাইডেলবার্গে। পেশায় তিনি গ্রাফিক ডিজাইনার! দেখছেন পৈতৃক ব্যবসাও।

কফি হাতে মেকআপ নিতে নিতেই কথা বলেছেন কিশোয়ার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বেঙ্গল মিট আয়োজিত ‘এন ইভনিং উইথ কিশোয়ার’ সেমিনারে প্রধান অতিথি হয়ে গত ডিসেম্বরে ঢাকায় এসেছিলেন কিশোয়ার চৌধুরী। আমন্ত্রিত হয়ে এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শেফ, রেস্তোরাঁ উদ্যোক্তা, ফুড ব্লগার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সাররা। অনুষ্ঠানে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা, সম্পৃক্ততা ও কালিনারি আর্টস নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা আর দৃষ্টিভঙ্গি আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন কিশোয়ার। বাংলাদেশের খাবার কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃতি পেতে পারে, আলোচনায় সেই বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে। রাজধানীর গুলশানে বেঙ্গল মিটের এ উৎসবে বাঙালি ভোজের কয়েকটি রেসিপিও সবার সঙ্গে ভাগ করে নেন কিশোয়ার।

রান্না করছেন কিশোয়ার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কিশোয়ারের ৬ বছর বয়সী মেয়ে সেরাফিনা আর ১৪ বছরের ছেলে মিকাইল—দুজনই ঢাকা খুব ভালোবাসে। সুযোগ পেলেই তাই সন্তানদের নিয়ে ফিরে আসেন মাটির টানে। সে রকমই ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’র মতো করে দেশে এসে বেঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেমিনারে অংশ নেন কিশোয়ার। কেন বেঙ্গল মিটের সঙ্গে যুক্ত হলেন? জানতে চাইলে এই শেফ বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় আমার বাবার অনেক বড় একটা গরুর খামার আছে। সেই সূত্রে বেঙ্গল মিটের সিইও এ এস এম আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই কথা হচ্ছিল। প্রতিবছর এখানে কোরবানি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এসব পশু যেভাবে উৎপাদিত হয়, এটাকে ঠিকঠাক একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম। বেঙ্গল মিট যেভাবে গরু উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করে, তা স্বাস্থ্যকর। এই মাংস কেনার আগপর্যন্ত কখনোই কিন্তু হাতের স্পর্শ পায় না। কেবল মাংস বিক্রি করেই বসে থাকতে চায় না বেঙ্গল মিট; পুরো প্রক্রিয়ায় একটা পরিবর্তন আনতে চায় তারা। আমিও সেটার সঙ্গে একমত। আর তাই যুক্ত হওয়া।’

নিজের দেশের খাবারকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে কাজ করে যেতে চান এই বাঙালি কন্যা। আর তাই দেশি পদের মধ্যে নানা রকম ফিউশন করে নতুন প্রজন্মের কাছে সেসবের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছেন।

কিশোয়ার চৌধুরী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কিশোয়ারের ৩ রেসিপি

রুই মাছের ঝোল
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

১. রুই মাছের ঝোল

উপকরণ: রুই মাছ ১ কেজি, শর্ষের তেল ৪ টেবিল চামচ, লবণ স্বাদমতো, হলুদ ১ চা–চামচ, আদা বাটা ১ টেবিল চামচ, আদাকুচি ১ চা–চামচ, পেঁয়াজকুচি ২ টেবিল চামচ, টমেটো পেস্ট ১ কাপ, টমেটো ফালি ৫টি, মটরশুঁটি ১ কাপ, পেঁয়াজের কলি ৮–১০টি, কাঁচা মরিচ কয়েকটি, লেবু ১ টুকরা, জিরাগুঁড়া আধা চা–চামচ, ধনেপাতা ২ টেবিল চামচ ও পানি।

 প্রণালি: রুই মাছ নিয়ে কিচেন টিস্যুতে ভালোভাবে মুছে নিন। তাহলে মাছের গায়ের পানি শুকিয়ে যাবে। কাটাকুটির ঝামেলায় যেতে না চাইলে বেঙ্গলের ‘রেডি টু কুক’ রুই মাছ নিতে পারেন। এটাও মুছে নিতে হবে। মাছগুলোতে এবার ১ টেবিল চামচ শর্ষের তেল, আদাবাটা আর লবণ দিয়ে ভালোভাবে মেখে ২০ মিনিট ম্যারিনেট করুন।

বাকি শর্ষের তেল প্যানে দিয়ে গরম করুন। মাছগুলো হালকা ভেজে উঠিয়ে নিন। ওই প্যানেই বাকি তেলে পেঁয়াজকুচি দিন। আদাকুচি ও হলুদ দিয়ে নাড়তে থাকুন। সামান্য পানি মিশিয়ে নিন। এতে মসলা পুড়ে যাবে না। মসলাটা ভুনা ভুনা হয়ে কড়াইয়ের সঙ্গে লেগে এলে প্রথমে টমেটো পেস্ট দিন। ফালি ফালি করা টমেটোগুলো ছড়িয়ে দিন। মটরশুঁটি ও একটু লবণ ছড়িয়ে ৫ মিনিট ঢেকে রাখুন। ঢাকনা তুলে মাছগুলো ছেড়ে দিন। ১৫ মিনিট ঢেকে রাখুন। লম্বা লম্বা করে কাটা পেঁয়াজের কলিগুলো ওপরে ছড়িয়ে দিন। ২ মিনিট অপেক্ষা করুন। মাঝে লবণ চেখে দেখুন। কাঁচা মরিচ দিয়ে তারপর লেবুর রস দিন। শেষ দিকে দিন ভাজা জিরাগুঁড়া। নামানোর আগে ধনেপাতাকুচি ছড়িয়ে নিন।

খাসির রেজালা
ছবি: সংগৃহীত

২. খাসির রেজালা

উপকরণ: ১ কেজি খাসির মাংস, আদাবাটা ১ টেবিল চামচ, রসুনবাটা ১ টেবিল চামচ, টক দই ২৫০ গ্রাম, ধনেগুঁড়া ১ টেবিল চামচ, গুঁড়া মরিচ ১ চা–চামচ, বেরেস্তা ১ কাপ ও ১ টেবিল চামচ, পেঁয়াজকুচি ১ কাপ, লবঙ্গ ৩টি, দারুচিনি ২টি, এলাচি ৩টি, তেজপাতা ৩টি, গোলমরিচ ১২টি, লবণ স্বাদমতো, কাজুবাদামের পেস্ট ১ কাপ, আদাকুচি ১ টেবিল চামচ, কাঁচা মরিচ কয়েকটি, ভেজিটেবল অয়েল ১ টেবিল চামচ, ঘি ৪ টেবিল চামচ, কিশমিশ ১ টেবিল চামচ, চিনি ১ টেবিল চামচ, লেবু ১টি ও পানি প্রয়োজনমতো

 

প্রণালি: আদাবাটা, রসুনবাটা ও টক দই দিয়ে মাংস ভালোভাবে মাখিয়ে পাত্রটি ঢেকে অন্তত ছয় ঘণ্টা ফ্রিজে রেখে ম্যারিনেট করতে হবে। ৬ ঘণ্টা পর ফ্রিজ থেকে বের করে তাতে ধনেগুঁড়া, আধা চা–চামচ মরিচগুঁড়া, ১/২ কাপ বেরেস্তা দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে আবার ৬ ঘণ্টার জন্য ফ্রিজে রেখে দিন। এভাবে মোট ১২ ঘণ্টা ম্যারিনেট হবে। ম্যারিনেট করার সময় ও রান্নার আঁচের ওপর রান্নাটা নির্ভর করে। অল্প আঁচে ধীরে ধীরে রান্না হবে খাসি।

একটি প্যানে আগে ভেজিটেবল অয়েল ঢেলে তার ভেতরে ঘি দিন। এরপর একে একে তেজপাতা, লবঙ্গ, দারুচিনি, গোলমরিচ ও ছেঁচা এলাচি ছেড়ে দিন। এই মসলাগুলো দিয়ে একবার ভালো করে নাড়ুন। ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষার পর দিন পেঁয়াজকুচি। পেঁয়াজ বাদামি হয়ে এলে চিনি দিন, তারপর আদাকুচি। আধা চা–চামচ মরিচগুঁড়া আর একটু ধনে দিন। মসলাগুলোর মধ্যে সামান্য লবণ দিন। এর ভেতর ছেড়ে দিন ম্যারিনেট করা মাংস। এবার কিছুটা লবণ দিন। ভালোভাবে নেড়ে এমনভাবে গরম পানি দিন, যাতে বেশির ভাগ মাংসই পানির নিচে থাকে। চুলার জ্বাল কমিয়ে ঢেকে রাখুন। ১ ঘণ্টা এভাবে থাকবে। এবার দেখুন ঝোলটা কেমন ঘন হয়ে এসেছে। এই পর্যায়ে লবণ চেখে নিন। এবার কাঁচা মরিচ ছেড়ে দিন কয়েকটা, তারপর দিন কিশমিশ। লেবু চিপে রসটুকু দিন। ঝোলটা আরও ঘন করতে কাজুবাদামের পেস্ট ঢেলে নেড়ে দিন। বাকি ১/২ কাপ বেরেস্তা ছড়িয়ে দিন ওপরে। চুলা বন্ধ করে ঢেকে রাখুন আরও ১০ মিনিট। ব্যস, খাসির রেজালা প্লেটে ওঠার জন্য প্রস্তুত!

মুরগির কোরমা
ছবি: সংগৃহীত

৩. মুরগির কোরমা

উপকরণ: মুরগি ১টি, আদাবাটা ১ চা–চামচ, রসুনবাটা ১ চা–চামচ, টক দই ৪ টেবিল চামচ, পেঁয়াজকুচি ১ কাপ, বেরেস্তা ১ কাপ, ভেজিটেবল অয়েল আধা টেবিল চামচ, ঘি ৩ টেবিল চামচ, ধনেগুঁড়া ১ চা–চামচ, কাজুবাদামবাটা ২–৩ টেবিল চামচ, কিশমিশ ১ টেবিল চামচ, লবঙ্গ ৩–৪টি, দারুচিনি ২ টুকরা, এলাচি ৩টি, তেজপাতা ২টি, গোলমরিচ ৭–৮টি, কাঁচা মরিচ ৫টি, ১ চা–চামচ চিনি, কেওড়াজল বা গোলাপজল অল্প ও লেবু ১ টুকরা।

প্রণালি: মুরগিটা কোরমা কাটে বড় টুকরা করে নিন। এবার সেটা ভালোভাবে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে আদাবাটা, রসুনবাটা আর টক দই দিয়ে মাখিয়ে ৬ ঘণ্টার জন্য ফ্রিজে ম্যারিনেট করে রাখুন। আগের রাতেও ম্যারিনেট করে রাখতে পারেন।

একটা প্যানে সামান্য ভেজিটেবল অয়েল নিয়ে তার মধ্যে ঘি দিন। এতে ঘি পুড়ে যাবে না। এবার একে একে দিন তেজপাতা, এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ ও গোলমরিচ। একটু নেড়ে সেখানে দিন পেঁয়াজকুচি। পেঁয়াজ বাদামি রঙের হয়ে এলে চিনি দিন। যেকোনো কোরমায় পেঁয়াজটা বাদামি হয়ে আসার পর চিনি দিলে পেঁয়াজের রংটাও ভালো থাকে। আবার পেঁয়াজের ভেতরে মিষ্ট ভাবটাও ভালোভাবে পৌঁছায়। এবার ম্যারিনেট করা মুরগি ছেড়ে দিন। এর ভেতর কেবল ধনেগুঁড়া দিন। তারপর দিন লবণ। নেড়েচেড়ে ঢেকে দিন। ২০ মিনিটের মতো অল্প আঁচে রান্না হবে। এবার কাজুবাদামের পেস্ট ও কয়েকটা কাঁচা মরিচ চিরে দিন। লেবু চিপে রসটুকু দিন, তাতে কিশমিশগুলো ছেড়ে দিন। নামানোর আগে সামান্য কেওড়ার জল বা গোলাপজল মেশাতে পারেন।

লেখাটি বর্ণিল খাবারদাবার ২০২৪—এ প্রকাশিত