গল্পটা একজন প্রোগ্রামারের, একজন ভাইয়ের, একজন উদ্যোক্তার
লেখার সঙ্গে যে ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন, সেটা লাবিব তাজওয়ার রহমানের ফেসবুক থেকে নেওয়া। ছবির সঙ্গে লাবিব ক্যাপশনে যা লিখেছেন, সেখানেই আদতে অল্পের মধ্যে তাঁর পুরো গল্পটা বলা আছে। ইংরেজিতে লেখা ক্যাপশনটির বাংলা করলে দাঁড়ায়—‘১০ বছর আগে কোড ডট অর্গ নিয়ে বিল গেটসের একটা ভিডিও থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি কোডিং শুরু করেছিলাম। আর ঠিক ১০ বছর পর কোড ডট অর্গের ১০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমাকে সম্মাননা জানানো হলো, আমারই কাজের জন্য, এমনকি বিল গেটসের উপস্থিতিতে! ছবিতে কোড ডট অর্গের সিইওর সঙ্গে আমি…’
এই ১০ বছরে কী কী ঘটল, যা লাবিবকে তাঁর স্বপ্নের এতটা কাছাকাছি নিয়ে গেল?
স্ট্যানফোর্ডের দিনগুলো
ঢাকার সেন্ট জোসেফ স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মাথায় চেপেছিল কোডিংয়ের ঝোঁক। দশম শ্রেণিতে যখন পড়েন, দুজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারে অনুষ্ঠিত কনরাড অ্যাওয়ার্ডে অংশ নিয়েছিলেন লাবিব। জায়গা করে নিয়েছিলেন সেরা ৬-এ। এ ছাড়া ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত ‘ফার্স্ট গ্লোবাল’ রোবোটিকস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের দলনেতা ছিলেন তিনি। মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই সার্ন বা ‘ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ নামের প্রখ্যাত বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পান।
স্নাতক–স্নাতকোত্তর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরুতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন লাবিব। কিন্তু প্রথম বর্ষে ডার্ক ম্যাটার গবেষণা দলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কম্পিউটার আর কোডিংই তাঁকে বেশি টানে। তাই তৃতীয় বর্ষে বিষয় বদলে বেছে নেন কম্পিউটার বিজ্ঞান।
সব মিলিয়ে এই তরুণের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটা ছিল দারুণ। পেয়েছেন ‘স্ট্যানফোর্ড আউটস্ট্যান্ডিং অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’। স্ট্যানফোর্ডের এক অধ্যাপকের অনুপ্রেরণায় ডিজঅ্যাবিলিটি ল্যাঙ্গুয়েজ গাইড নামে একটা বই লিখেছিলেন লাবিব। যা পরে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার, এমনকি জাতিসংঘের মতো সংস্থাও নানা কাজে লাবিবের এই বই ব্যবহার করে। ডিজঅ্যাবিলিটি বা প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে কীভাবে তাঁর আগ্রহ হলো, কেমন করে এ নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন, সে-ও এক অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প।
ভাইয়ের জন্য
বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই ২০১৫ সালে ইনক্লুশনএক্স নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন লাবিব। মূলত বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য। স্কুলপড়ুয়া এক টগবগে কিশোর যখন মানসিক স্বাস্থ্য কিংবা মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন, একটু অবাকই হতে হয়। ওই বয়সে এমন অনুপ্রেরণা কোথায় পেয়েছিলেন?
যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুঠোফোনে লাবিব বলেন, ‘আমার বড় ভাইয়ের সেরিব্রাল পালসি ছিল। তিনি যখন মারা যান, আমি তখন স্কুলে পড়ি। ভাইয়ের মৃত্যুর প্রায় দুই সপ্তাহ পর যেদিন প্রথম স্কুলে যাই, এক সহপাঠী এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তোর ভাই নাকি পাগল ছিল?”শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের বিষয়ে জানে না বলেই এমনটা বলছে। তখনই ইনক্লুশনএক্সের মতো একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা মাথায় আসে।’
ইনক্লুশনএক্সের সঙ্গে আছেন একদল নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবক। স্কুলে স্কুলে গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা দেন তাঁরা। দেওয়া হয় কম্পিউটার-সংক্রান্ত নানা প্রশিক্ষণ। প্রতিষ্ঠানটি থেকে উপকার পেয়েছেন অনেকেই। একজনের গল্প শোনালেন লাবিব তাজওয়ার, ‘কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে যুক্ত হয়েছিল বুদ্ধিগত দিক থেকে বিশেষভাবে সক্ষম একজন। সে কথা বলতে বা লিখতে পারত না। আমার ভাইয়ের স্কুলেই পড়ত। আমাদের কম্পিউটার প্রোগ্রাম দেখে তার মা আমাকে প্রায়ই বলতেন, আমি তো এত দিন ধরে লেখাই শেখাতে পারিনি। ও কীভাবে কম্পিউটার শিখবে?’
ইনক্লুশনএক্সের স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রায় ৬ মাস চেষ্টা চালিয়ে যান। বুঝতে পারেন, ভাষা বুঝতে কষ্ট হলেও বিভিন্ন আকৃতি, নকশা বা ছবি এই শিক্ষার্থী চিনতে পারে। স্বেচ্ছাসেবকেরা তখন তাকে থ্রিডি মডেলিং শেখানো শুরু করে। থ্রিডি মডেলিংয়ে ভাষা শিখতে হয় না। কিছু টুলস কাজে লাগিয়েই চেয়ার, টেবিল, স্টেডিয়াম বা যন্ত্রাংশের নকশা বানানো যায়।
লাবিব খুব আনন্দ নিয়ে বলছিলেন, ‘অ্যানিমেশন বানানোর কাজ সে বুঝেছে। পাওয়ার পয়েন্টে অ্যানিমেশন দেখে হুবহু বানাতে পেরেছে। ১৫ বছর ধরে যে একটা শব্দ লিখতে পারেনি, সে কিন্তু আমাদের মডিউলে শিখে ডিজাইন করতে পারছে। এটা দেখে তার মা একদিন আমার সামনে এসে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, “আমার ছেলে এখন এমন কিছুও করতে পারে, যেটা আমি পারি না।”’
এক বন্ধুকে নিয়ে সম্প্রতি ‘হিউয়ি’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন লাবিব। এটি মূলত বিশেষভাবে সক্ষম শিশু ও তাদের মা-বাবাকে সাহায্য করবে। আপাতত কার্যক্রমটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই চালু আছে, কেননা লাবিবদের এই প্রকল্প পরিচালনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োজন। তবে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও হিউয়ির সেবা দিতে চান এই তরুণ।
রোবটের নাম নিউবিলিটি
২০১৭ সালে অন্য একটি প্রকল্পে স্বয়ংক্রিয় রোবট তৈরি করেন লাবিব ও তাঁর দল। নাম দেন নিউবিলিটি। এই রোবট একদিকে যেমন গ্রাহককে খাবার বা পণ্য পৌঁছে দিতে সক্ষম, তেমনি নিরাপত্তা রক্ষার কাজও করতে পারে।
লাবিব তাজওয়ার বলেন, ‘স্কুলে থাকতেই নাসায় একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে কোরিয়ার দুই নাগরিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। অনলাইনে বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রকল্পে কাজ করতাম। যখন স্ট্যানফোর্ডে পড়তে যাই, ওরাও তখন যুক্তরাষ্ট্রে আসে। তিন বন্ধু মিলে তৈরি করি নিউবিলিটি৷ কোরিয়া বা আমেরিকায় বিশাল বিশাল জায়গা নিয়ে গলফ কোর্স, কান্ট্রি ক্লাব বা ক্যাম্প সাইট আছে। এসব জায়গায় খাবার বা পানীয় পরিবহনের কাজ আমাদের স্বয়ংক্রিয় রোবট বেশ সাফল্যের সঙ্গে করে যাচ্ছে। অন্যদিকে সিকিউরিটি রোবট টহল দেওয়ার কাজ করে।’
নিউবিলিটির জন্যই ২০২৩ সালে বিশ্বখ্যাত সিইএস ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড পান লাবিবরা। পেয়ে যান প্রায় তিন শ কোটি টাকার বিনিয়োগ।
কোড ডট অর্গের সম্মাননা
এতসব কাজের সুবাদেই গত বছর অক্টোবরে ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত কোড ডট অর্গের ১০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন লাবিব তাজওয়ার রহমান। অনুষ্ঠানে লাবিবকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট ক্যামরেন উইলসন।
লাবিব বলেন, ‘আমি কোড ডট অর্গের বোর্ড অব ডিরেক্টরদের সঙ্গে এক টেবিলে বসেছিলাম। ভিশাল সিক্কার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছি, যিনি ইনফোসিসের সিইও ছিলেন। এখন ওরাকল ও বিএমডব্লিউয়ের বোর্ডে আছেন। তিনিও ১৯৯৬ সালে স্ট্যানফোর্ডে পড়েছেন। উবারের সিইও দারা খসরোশাহীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়েছে।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে লাবিব বলেন, ‘আমার তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই আরও বড় করার স্বপ্ন আছে। এমনভাবে বড় করতে চাই, যেন প্রতিষ্ঠানগুলো আমার অবর্তমানেও সুন্দরভাবে চলে। কাজগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি করাই আমার লক্ষ্য। কারণ, এমন কাজই সব সময় করতে চেয়েছি, যা অন্য কেউ করছে না।’