৫০ হাজার প্রতিমার কারিগর দুলাল পাল
দাওয়ায় বসে প্রতিমার জন্য চুল সাজাচ্ছিলেন দুলাল পাল। খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটা শেষ করে ঘরে ঢুকলেন। ভেতরে কয়েকটা প্রতিমা পাশাপাশি রাখা। কিছু উপকরণ এনে সহযোগী তাঁর হাতে দিতেই প্রতিমায় চুল জুড়ে দিতে থাকলেন দুলাল।
সিলেট নগরের দাড়িয়াপাড়া এলাকায় দুলাল পালদের দোকান। এবার এখানে বিভিন্ন আকারের ৮০টি প্রতিমা তৈরি হয়েছে। মহালয়ার দিন গিয়ে দেখি মূর্তিগুলো সাজিয়ে তোলার শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। ব্যস্ততার মধ্যেই দুলাল পালের সঙ্গে আড্ডা জমে ওঠে।
দুলাল পালের বয়স এখন ৫৭। তার মধ্যে ৪০ বছর ধরে প্রতিমা গড়ছেন তিনি। দুর্গাপ্রতিমা ছাড়াও কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, মনসাসহ সব দেব-দেবীর মূর্তিই তিনি গড়েন। আট সহযোগী নিয়ে কোনো কোনো দিন ছোট ছোট ১৫০ প্রতিমাও বানিয়েছেন তিনি। সেই হিসাবে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় অন্তত ৫০ হাজার মূর্তি গড়েছেন বলে জানান দুলাল।
সাত পুরুষের ব্যবসা। শুরুতে দুলালদের দোকানের কোনো নাম ছিল না। দুই দশক আগে নাম রাখা হয় ‘নারায়ণ-বল্লভ মৃৎ শিল্পালয়’। দুজনের নামে দোকানের এই নাম। তার মধ্যে নারায়ণ হচ্ছেন দুলাল পালের বাবা। বাবার কাছ থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ শিখেছেন দুলাল। তাঁর বাবা শিখেছেন দাদু বল্লভ পালের কাছ থেকে। এভাবেই বংশপরম্পরায় দেখে দেখে তাঁদের প্রতিমা তৈরির কাজ শেখা। দুলালের ভাষায়, ‘দেখনাদেখি শিখা’।
‘দেখনাদেখি শিখা’য় শিক্ষিত হয়েছেন দুলাল ও তাঁর ছোট ভাই নন্দলাল পাল। অন্য তিন ভাই এই পেশায় আসেননি। ২০ থেকে ২২ বছর আগে তাঁদের বাবা মারা যান। এরপর পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে দুলালই ধরেন ব্যবসার হাল। সারা বছর ধরেই এখানে নানা প্রতিমা তৈরি ও বিক্রি হয়। দুলাল বলেন, ‘১২ মাসে ১৩ পূজা লেগেই থাকে। সব পূজার মূর্তিই আমরা তৈরি করি।’
সিলেটসহ দেশের নানা অঞ্চল থেকে তাঁরা প্রতিমা নির্মাণের এঁটেল মাটি সংগ্রহ করেন। বাসার নিচেই চলে দুলালদের প্রতিমা তৈরির কাজ। ওপর তলায় থাকে তাঁদের পরিবার। আলাপে আলাপে জানালেন, স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। এখনো তাঁদের যৌথ পরিবার।
দুলাল পাল জানান, প্রতিবছর গড়ে তিন হাজার প্রতিমা বিক্রি করে থাকেন তাঁরা। এ বছর পূজারিদের চাহিদা অনুযায়ী তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে ৮০টি প্রতিমা প্রস্তুত করা হয়েছে। সিলেট ছাড়াও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এবং সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজারসহ নানা স্থানে তাঁদের তৈরি প্রতিমায় পূজা হচ্ছে। প্রতিমা নির্মাণে বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তাঁরা সব সময়ই ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। ফলে তাঁদের মূর্তি কেনার জন্য পূজারিদের আগ্রহও থাকে বেশি।
দুলাল পাল বলেন, ‘প্রতিমা গড়ার কাজে আনন্দ পাই বলেই এখনো এই পেশায় টিকে আছি। না হলে উপকরণের দাম যেভাবে বেড়েছে, সে অনুযায়ী প্রতিমার দাম খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না। কেবল ভাবি, যদি প্রতিমা নির্মাণ বন্ধ করে দিই, তাহলে মানুষ পূজা করবে কী করে?’