‘দুঃখিত স্যার, বাবা বলেছেন সবার আগে পড়ালেখা’

একটা সময় পর্যন্ত তিনিই ছিলেন বিশ্বের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ বিলিয়নিয়ার। শত বাধা অতিক্রম করেই অপরাহ উইনফ্রে জিতেছেন অস্কারসহ বহু পুরস্কার। ৬ মে টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে (টিএসইউ) সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এই বিখ্যাত মার্কিন উপস্থাপক। পড়ুন অংশবিশেষের অনুবাদ।

অপরাহ্‌ উইনফ্রে
ছবি: রয়টার্স

একটা স্বীকারোক্তি দিয়ে শুরু করি। টিএসইউ থেকে আমার পাস করার কথা ছিল ১৯৭৫ সালে। কিন্তু দেখা গেল, স্নাতকের জন্য যতগুলো ক্রেডিট সম্পন্ন করতে হয়, আমার তার চেয়ে একটা কম। কী আর বলব। এই বিদ্যাপীঠ আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে, তবে নিজের ক্রেডিট গুনে রাখা শেখায়নি।

সে সময় আমার কত যে ব্যস্ততা। বাবার বাড়িতে থাকি। প্রতিদিন উত্তর ন্যাশভিলে যাই-আসি। বাবার দোকানে কাজ করি। সপ্তাহান্তে ডব্লিউভিওএল রেডিও স্টেশনে খবরও পড়ি।

আমার পড়ালেখার মূল বিষয় ছিল ‘বাচনিক যোগযোগ ও নাটক’। অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা বলতেন, আমি চাই না আমার মেয়ে ওসব নাটক-ফাটক করুক। অগত্যা ঠিক করেছিলাম, শিক্ষক হব। কিন্তু মঞ্চসজ্জার ক্লাস নিয়ে আমাকে বেশ ভুগতে হচ্ছিল। বিষয়টা পড়াতেন ড. ডব্লিউ ডিউই কক্স। সবার সামনে তিনি বলতেন, ‘উইনফ্রে তো একটা সরলরেখাও আঁকতে পারে না। এমনকি স্কেল দিয়েও না!’

এক দিন তাঁর ক্লাস চলাকালীন সময়ই আমার কাছে একটা ফোন এল। ফোন করেছিলেন ক্রিস ক্লার্ক। তিনি তখন ডব্লিউএলএসিটি চ্যানেল ফাইভের মূল উপস্থাপক ও সংবাদ পরিচালক ছিলেন। এখন চ্যানেলটা ডব্লিউটিভিএফ নামে পরিচিত। ঘটনাক্রমে ডব্লিউভিওএল রেডিওতে ক্রিস আমার কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন। কোন দুঃখে তিনি এমন একটা অখ্যাত রেডিও চ্যানেলে কান পেতেছিলেন, কে জানে! সে যা–ই হোক। ফোন করে তিনি জানতে চাইলেন, আমি টেলিভিশনে কাজ করতে আগ্রহী কি না। আমি বললাম, ‘ইয়ে মানে ... দুঃখিত স্যার। বাবা বলেছেন সবার আগে পড়ালেখা। মনে হয় না বাবা রাজি হবেন।’ ক্রিস বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি আমাকে ভেবে জানাও।’

আরও পড়ুন

ক্লাসে ফিরে আমি মিস্টার কক্সকে বিষয়টা জানালাম। সব শুনে তার চেহারাটা হলো উইজার্ড অব ওজ সিনেমার সেই সিংহের মতো। ওই চেহারা আর যা-ই হোক, স্বস্তিকর নয়। তিনি বললেন, ‘আরে গর্ধভ, সিবিএস নয়তো চ্যানেল ফাইভ থেকে যেন ডাক আসে, সেই জন্যই তো তুমি এখানে পড়তে এসেছ। তুমি আর তোমার বাবা কি এই সামান্য বিষয়টা বুঝতে পারছ না?’ রেগেমেগে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বললেন, ‘তোমার বাবার সঙ্গে আমি কথা বলব।’

তিনি বাবার সঙ্গে কথা বললেন। অতএব দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকেই বেলা দুইটার মধ্যে সব ক্লাস শেষ করে আড়াইটার মধ্যে টেলিভিশনে হাজিরা দিতে শুরু করলাম। রাত ১১টার পরে বাবা প্রদত্ত কারফিউ জারি হয়ে যেত। অতএব রাত সাড়ে ১০টায় সন্ধ্যার খবর পাঠ শেষ করে রাত ১১টার আগেই আমাকে বাড়ি পৌঁছাতে হতো।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অপরাহ্‌
ছবি: রয়টার্স

স্নাতক সম্পন্নের সময় যখন এল, তখন দেখা গেল ক্যারিয়ার নিয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ত। ডিগ্রি নেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। সুতরাং অপরাহ উইনফ্রে শো চালু করার বেশ কয়েক বছর পর্যন্তও বাবার সঙ্গে আমার এমন কোনো কথোপকথন হয়নি, যেখানে তিনি বলেননি, ‘সবই বুঝলাম, কিন্তু ডিগ্রিটা কবে নিচ্ছ?’ অবশেষে ১৯৮৮ সালে ড. জেমি উইলিয়ামস আমাকে সুযোগ করে দেন। আমি যেন কিছু প্রবন্ধ জমা দিয়ে ডিগ্রিটা নিতে পারি। তৃতীয় এমি অ্যাওয়ার্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, দুটা আমি একই সময়ে পেয়েছি। যদিও স্নাতক করতে আমার একটু বেশি সময় লেগে গেছে। তবে আমি তোমাদের নিশ্চিত করতে পারি, তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গর্বিত প্রাক্তনের কথাই শুনছ।

জানি না, ভবিষ্যৎ আমার জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু জানি, ভবিষ্যৎটা কার হাতে। সারাটা জীবন সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ আমাকে পথ দেখিয়েছে। অনেকে জিজ্ঞেস করে, আমার সাফল্যের রহস্য কী। আমি বলি, আমি সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছি।

জীবন সব সময় আমাদের নানা বার্তা দেয়। শত কোলাহলের মধ্যে তুমি সেই বার্তাটা আলাদা করে শুনতে পাচ্ছ কি না, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়াজটা হয়তো খুবই ক্ষীণ, কিন্তু এর মধ্যেই তুমি তোমার নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাবে। বুঝতে পারবে, তোমার হৃদয় কী চায়। আমি আমার জীবনে যত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওই ক্ষীণ আওয়াজই আমাকে পথ দেখিয়েছে।

সৃষ্টিকর্তার কাছে সব সময় আমার একটাই প্রার্থনা, ‘হে ঈশ্বর, আমাকে কাজে লাগাও। তুমি আমাকে যেখানে দেখতে চাও, সেখানেই নিয়ে যাও।’ জেনে রেখো, তোমাকে নিয়ে তোমার ভাবনার চেয়েও বড় পরিকল্পনা করে রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং। তোমার কাজ হলো শুধু তার পরিকল্পনার সঙ্গে নিজের পরিকল্পনা মিলিয়ে নেওয়া।

অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ