‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ খেতাবজয়ী মেয়েটির সংগ্রামের গল্পটাও শুনুন

মিস ওয়ার্ল্ডের ঝলমলে মঞ্চে আমরা তাঁকে দেখেছি। হাসিখুশি, চঞ্চল এক তরুণ। তবে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শাম্মী ইসলামের এত দূর পৌঁছানোর পেছনে কিন্তু একটা সংগ্রামের গল্প আছে। সেটাই শোনা যাক এবার।

শাম্মী ইসলাম নীলাছবি: অগ্নিলা আহমেদ

তখন দুপুর। পোশাক বিক্রির একটা লাইভ ভিডিও নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন নীলা। টের পাচ্ছিলেন, ফোন আসছে বারবার কিন্তু কাজ ফেলে ফোন ধরার সুযোগ হচ্ছিল না। লাইভ শেষে ফিরতি কল করে জানলেন, বাবার অবস্থা খুব খারাপ। তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করাতে হবে। নীলা মাকে বললেন, ‘যা করতে হয় করো। টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি আছি তো।’
বলছি মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ শাম্মী ইসলামের কথা। নীলা নামেই যিনি পরিচিত বেশি। কিছুদিন আগে ভারতে অনুষ্ঠিত ৭১তম মিস ওয়ার্ল্ডের মঞ্চে আরও ১১৭টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।

‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ হিসেবেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন নীলা
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

সেদিন বাবাকে আইসিইউতে রেখেই পরের লাইভে মন দিতে হয়েছিল নীলাকে। কেননা তাতে কিছু টাকা আসবে। হাসপাতালের বিল দিতে সুবিধা হবে। লাইভ শেষে, হাসপাতাল ঘুরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেজে গিয়েছিল রাত তিনটা। ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই এসেছিল খবর—বাবা আর নেই।

আত্মীয়স্বজনকে জানানো, দাফনের ব্যবস্থা করা, কত কাজ। দাফন ও অন্যান্য খরচ মেটাতে পরিচিত এক চাচাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন তিনি। পরে জেনেছেন, সেই চাচা টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছেন। পৃথিবী কতটা নিষ্ঠুর, বোঝার শুরু তখন থেকেই। বাবার প্রিয় রাজকন্যা সেদিনই যেন বড় হয়ে গিয়েছিলেন হুট করে।

দুঃসময়ের শুরু

কিডনির সমস্যা নিয়ে ২০০৬ সাল থেকে ভুগছিলেন নীলার বাবা জহিরুল ইসলাম। একে একে জমানো টাকা ফুরাল, ৯ বছরের ছোট ভাই একদিন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করল, তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। সেই বিরতি চলল প্রায় দুই বছর। ব্যবসার অংশীদারেরা কয়েকজন টাকাপয়সা নিয়ে বিদেশ চলে গেলেন। বাকিদের আর খোঁজ পাওয়া গেল না। জহিরুল ইসলামের ওপর এসে পড়ল ব্যাংকের সমস্ত ঋণ। ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হলো। এত সব ঝক্কির মধ্যেই এসএসসি-এইচএসসি পেরিয়ে নীলা যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন, সেদিনই হয় বাবার স্ট্রোক।
এরপর হন্যে হয়ে কাজ খুঁজেছেন নীলা। নিজের জন্য, বাবার চিকিৎসার জন্য, মায়ের জন্য, ভাইয়ের জন্য...।

নীলা
ছবি: অগ্নিলা আহমেদ

পরিচিত এক আপুর মাধ্যমে ফেসবুক লাইভে পোশাক বিক্রির কাজ মিলল। প্রথম দিন এক ঘণ্টা লাইভ করে পেয়েছিলেন ৫০০ টাকা। এরপর একটা চাকরিও জুটে গেল। কথা ছিল ফেসবুক পেজের ব্যবস্থাপনা করবেন, লাইভও করবেন। মাসে পাবেন ২০ হাজার টাকা। অথচ প্রথম মাসে দেওয়া হলো ছয় হাজার টাকা। পরের মাসে তা-ও না। একেবারে শূন্য। বেতন চাইতেই চাকরিটা গেল।

আরও পড়ুন

সংগ্রামের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে নীলা বলছিলেন, ‘আমার মা সংসার করেছে আট বছরের মতো। বাকি সময়টা হাসপাতাল থেকে বাসা, বাসা থেকে হাসপাতাল। নার্স হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় একদিন আমি নিজে নিজে ভাত বসাতে গিয়ে হাত পুড়ে গিয়েছিল। নিজেই হাত ব্যান্ডেজ করেছি, আবার ভাত বসিয়েছি। ভাইটা তখন ছোট। আমাদের অবস্থা বোঝার মতো বয়স ওর হয়নি।’

নীলা পড়েন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে
ছবি: অগ্নিলা আহমেদ

ঘুরে দাঁড়ানো

লাইভ করতে করতেই বড় বড় ফ্যাশন হাউসের চোখে পড়ে যান নীলা। এরপর একের পর এক কাজ আসতে শুরু করে। নীলা বলেন, ‘আমার জন্য বোধ হয় বাবার অনেক দোয়া ছিল। শুরুর দিকে অনেক লাইভ করেছি, কোনো টাকা পাইনি। তবে হাল ছাড়িনি। করেই গেছি। বিশ্বাস করেছি যে কিছু একটা হবে। একসময় লাইভ করে এত টাকা আসতে শুরু করল, যেটা আমি ভাবিনি।’
২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিলেও নানা ধকল সামলে নীলা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএতে ভর্তি হন ২০২১ সালে। ভাইকেও ভর্তি করেন ভালো স্কুলে। এখন ব্যস্ততা এতটাই বেড়েছে যে একজন ম্যানেজারও নিয়োগ দিতে হয়েছে। নীলার ম্যানেজার আবরার উদয়ও পড়েন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতেই।
নীলাকে না জানিয়ে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০২৩–এর জন্য তাঁর নাম নিবন্ধন করেছিলেন আবরার। মূত্রনালির সংক্রমণ নিয়ে নীলা তখন হাসপাতালে ভর্তি। হাত থেকে ক্যানুলা খুলে সোজা হাজির হয়েছিলেন প্রতিযোগিতাস্থলে। এর পরের ঘটনা সবার জানা। মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের মুকুট পরে আন্তর্জাতিক পর্বে অংশ নিয়েছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষার্থী।
সহপাঠীদের ধন্যবাদ দিয়ে নীলা বলছিলেন, ‘ওরা না থাকলে কী হতো জানি না। জীবনে কোনো কিছু মনেপ্রাণে চাইলে এভাবেই বোধ হয় মিলে যায়। আমার ক্লাসের বন্ধুরা সব নোট জোগাড় করে রাখত। যেটা পারতাম না, বুঝিয়ে দিত। ফলে ক্লাস কম করলেও পরীক্ষায় ঠিকই উতরে গেছি। ওরা আসলে আগে থেকেই আমাকে নিয়ে অনেক গর্বিত।’