মোবাইলটা কেউ টান দিল না কেন

এ শহরে গাড়ির কাচ নামিয়ে মোবাইলে কথা বলা একরকম ‘দুঃসাহস’ বটে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

গাড়ির জানালাটা আধখোলা। শাল গায়ে শীতের বাতাস উপভোগ করতে করতেই চলেছি। বসেছি চালকের পাশের আসনে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। কথা বলে যাচ্ছি। এক মিনিট, দু মিনিট...পাঁচ-ছয় মিনিট হয়ে গেছে। আচমকা সংবিৎ ফিরে পেলাম। আমার সাহস তো কম না! জানালা খোলা রেখে এতক্ষণ মোবাইলে কথা বলে যাচ্ছি? ফোনটা আছে তো? নাকি পরিবারের একজন বয়স্ক মানুষের মতো ছিনতাইকারী গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল নিয়ে যাওয়ার পরও কানে হাত দিয়ে কথা বলে যাচ্ছি! মোবাইলের উপস্থিতি নিশ্চিত করলাম। আরে আছে তো দেখি! মনে মনে ভাবছি, আশ্চর্য! এতক্ষণ ধরে কথা বলছি, কেউ আমার মোবাইলটা টান মেরে নিল না? কী করে সম্ভব?

আরও পড়ুন

চান্দের গাড়ির পেছন থেকে দলের সম্মিলিত হাসিতে যেন ধ্যান ভাঙল। ওহ্, আমি তো বান্দরবানে। চলেছি পাহাড়ি রাস্তা ধরে। দুই পাশে জনমানব নেই। তাই তো বলি, এত সাহস কোথা থেকে এল?

প্রতিদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে কারওয়ান বাজার থেকে সোনারগাঁও মোড় হয়ে ফার্মগেটের দিকে একটু এগোলেই পরিচিত একটা দৃশ্য চোখে পড়বেই। থামবে কি থামবে না করা গতির একটা বাসের জানালা দিয়ে যাত্রীরা মাথা বের করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। যানজটে আটকে থাকা সামনের কয়েকটা গাড়ির ফাঁক দিয়ে অন্ধকারে দৌড়াচ্ছে একজন। চোখের নিমেষেই উধাও। বাস থেকে নেমে কেউ পেছন পেছন ছোটে কখনো কখনো, গাড়ির চালকেরা পরস্পর পরস্পরকে বলবে, ‘ওই যে নিল, মোবাইল নিল’। ঢাকা শহরে এ রকম বেশ কয়েকটা চিহ্নিত স্থান আছে। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে সব আমাদের গা-সওয়া। আমি নিশ্চিত যাদের জীবনে এই ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে, তাদের উল্টো শুনতে হয়েছে, ‘জানালা খোলা রেখে কথা বলতে গেলেন কেন?’ ‘একটু সাবধান হবেন না?’ ‘বেশি দামি ফোন তো না, আফসোস কইরেন না।’ ‘আমি হলে ঠিক ধরতাম, একবার হয়েছিল কি…।’

আমাদের আলোকচিত্রী বোনটিরও ঘটেছিল মোবাইল হারানোর ঘটনা। কারওয়ান বাজারের ভ্যানগাড়িতে কোনো জিনিস কিনতে গিয়ে হারাল মোবাইল। এক মাসে দ্বিতীয়বার। যে মোবাইল তার কাজের জন্য অনিবার্য। ছাড়েনি সে। সন্দেহভাজন দম্পতিকে (সাজানো) ধরে আদায় করে ছেড়েছিল মোবাইলটি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই। যার যায়, সে-ই জানে কী যায়। গল্পটা যখন আলোকচিত্রী বোনটি আমাদের বলছিল, তখন ওর গলা ধরে আসছিল বারবার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রীও ধরেছিল ছিনতাইকারীকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই। শিক্ষাজীবনের জরুরি উপাত্ত ছিল তার ফোনে। খবরও হয়েছিল। ওরা দুজন যা পেরেছে, আমরা তা পারি না। আমরা তো বেশির ভাগই সেই নির্বিকার শহরবাসী।

আমার অবস্থা আরও খারাপ। গাড়ির জানালা খোলা রেখে ফোনে কথা বললাম, কিছুক্ষণ পর যখন দেখলাম ফোনটা কেউ টান মারেনি, তাতেই এত খুশি, এত প্রাপ্তি। না হোক তা ঢাকার কারওয়ান বাজার, হোক না তা বান্দরবান, ফোনটা তো হারাইনি। মেনে নিতে নিতে, ছাড় দিতে দিতে কোথায় এসে দাঁড়ালাম?

আহারে জীবন!