ঈদ নিয়ে কোন তারকার কী স্মৃতি
‘ওল্ড ইজ গোল্ড’—এই সূত্র মেনে এই তারকাদের মতে ‘ঈদ ছিল ছোটবেলায়’। সেগুলোকে বলে সত্যিকারের ঈদ। এখন ক্যালেন্ডারের পাতার সঙ্গে সঙ্গে চেনা মুখ, শহর, সম্পর্কসহ বদলে গেছে ঈদের রং আর আমেজ। তারকাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ‘পুরোনো সেই ঈদের কথা’। সবার কাছে সেই নস্টালজিয়ার ঈদের গল্প শুনেছেন জিনাত শারমিন
জোর করেই সালামি নিতেন আজিম
মডেল আজিম উদ–দৌলার ছেলেবেলা কেটেছে বাগেরহাটে। কলেজজীবন পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। তখন বাগেরহাট এখনকার তুলনায় অনেক সবুজ ছিল, ছিমছাম নিরিবিলি শহর। তিন ভাই, তিন বোনের ভেতর আজিম সবার ছোট। ঈদের দিন ভোরবেলা উঠে গোসল সেরে নতুন পাঞ্জাবি পরে নামাজে যেতেন। ঈদগাহ থেকে ফিরে সেমাই খেয়ে চলত ঈদের সালামি তোলা। বাবা, চাচারা স্বপ্রণোদিত হয়েই সালামি দিতেন। যাঁরা দিতে চাইতেন না, তাঁদের কাছ থেকে জোর করেই নিতেন। ‘তারপর ঘুরতে বের হতাম। আসলে যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার মজাটাই আলাদা। জামাকাপড় লুকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা চলত। ছোটবেলায় আমার বড় ভাই আমাকে ঈদে কিছু না কিছু একটা উপহার দিতেনই! আর সেটা হতো সবচেয়ে সুন্দর। এখন আমি সেই বড় ভাই, ভাগনে, ভাগনি, বোন—সবার জন্য উপহার পাঠাই’—বললেন এই মডেল।
তখনো গ্রামে নুডলস যায়নি
তরুণ তারকা অভিনয়শিল্পী খায়রুল বাসারের মতে, ছোটবেলার ঈদই ঈদ, এখনকার ঈদে মজা নেই।’ এই অভিনেতার মতে, তখনকার ঈদের বর্ণনা করা কঠিন, কেননা তার পুরোটাই অনুভবের বিষয়। বাসারের জন্ম কিশোরগঞ্জে। সেখানেই কেটেছে ছোটবেলার বেশ কয়েকটা ঈদ। দুই ভাই, তিন বোনের ভেতর বাসার চতুর্থ। সেই সময় ঈদের দিন গ্রামে বিভিন্ন পিঠা বানানোর চল ছিল। নকশি পিঠা, মসলা পিঠা, সমুচা পিঠা আর পায়েস, সেমাই তো ছিলই। তবে নুডলস ছিল না। কেননা গ্রামে তখনো নুডলস যায়নি। একবার ঈদে বাসারদের আর্থিক অবস্থা খুব শোচনীয়। বড় ভাই দুটো টিউশনি করতেন। সেটাই ছিল একমাত্র আয়ের উৎস। তা–ও ঈদের আগে একটা টিউশনির টাকা পেয়েছিলেন, আরেকটা পাননি। সেই টাকায় কেনা হলো ছোলা, পোলাওয়ের চাল আর দুটো খাসির মাথা। ঈদের কেনাকাটা বলতে এটুকুই। কারও জন্য বাড়তি কোনো কেনাকাটা করা হয়নি। সেবার ঈদের দিন সকালে বাসারের বড় ভাই তাঁকে একটি নতুন পাঞ্জাবি দিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বাসারও নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলেন না। বাসার বলেন, ‘ওই দিন আমি বুঝেছিলাম, পরিবার কী। পরিবারের জন্য কিছু করতে পারলে কেমন লাগে। ওই একটি ঘটনা আমাকে পরিবারের মূল্য আর পরিবারের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ বুঝিয়েছিল। আর বুঝিয়েছিল, যারা উপহার পায় আর দেয়, তারা জানে, উপহার পাওয়ার চেয়ে উপহার দেওয়ার আনন্দ অনেক গভীর, অনেক তীব্র।’
অনেক বছর পর বাসার এবারের ঈদে ফিরবেন তাঁর সেই ছোটবেলায় কাটানো ঈদগাহে, কিশোরগঞ্জে।
ঈদ ছিল আয়ের একমাত্র উৎস
অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা পুরোদস্তুর পুরান ঢাকার মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই নাকি তিনি স্টাইলিশ। বাবাকে দেখেই ফ্যাশনিস্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা পান। ভাবনার বাবা ছিলেন বিজ্ঞাপন নির্মাতা। সে কারণে হামেশাই যেতেন ভারতের মুম্বাই। সেখান থেকেই আসত দুই কন্যার ঈদপোশাক। ঈদই ছিল ভাবনার আয়ের একমাত্র উৎস। ঈদের দিন সালামি হিসেবে যে টাকা পেতেন, সেটা জমে বেশ ভালো পরিমাণ হয়ে যেত। এই টাকা জমিয়ে মা–বাবার বিবাহবার্ষিকী বা ছোট বোনের জন্মদিনে কিনতেন উপহার। নিজের জন্যও ছোটখাটো নানা কিছু কিনতেন। ঈদের পোশাক কাউকে না দেখানোর চল ছিল। তাই লুকিয়ে রাখতেন।
একবার আর্থিক টানাপোড়েনে ঈদের আগের দিন ভাবনার বাবা নিউমার্কেট থেকে একটা পোশাক কিনে এনেছিলেন তাঁর জন্য। তাই দেখে ভাবনার সে কী মন খারাপ! কিন্তু ঈদের দিন সকালবেলা তাঁর খুশি দেখে কে! কেন? কারণটা শোনা যাক ভাবনার মুখেই, ‘আমি মন খারাপ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু মা সেই রাতে ঘুমাননি। তিনি সেই পোশাকে সুতার কাজ করে নকশা এঁকে, চুমকি, লেইস লাগিয়ে একটা অভিজাত পোশাকে পরিণত করেছিলেন। সকালবেলা উঠে দেখি, বিছানায় নতুন জামা। সকালবেলা ওই পোশাকটা পরে আমার নিজেকে মনে হয়েছিল রূপকথার সিনড্রেলা।’
এখন ঈদে ভাবনা সবাইকে উপহার দেন। প্রতিবছর মিলিয়ে একই ধাঁচের পোশাক পরেন পরিবারের চারজনে। আর সেই ছবি ছাপা হয় পত্রিকার বিনোদন পাতায়। তাতে দারুণ খুশি হন এই নায়িকা।
ঈদের ব্যাগের মেয়াদ তিন দিন
সংগীত তারকা কনার বড় হয়ে ওঠা ঢাকাতেই। ছোটবেলার ঈদের সঙ্গে আর কোনো কিছুরই তুলনা চলে না বলে জানালেন এই শিল্পী। বললেন, ‘শুধু ঈদ নয়, ছোটবেলার সবকিছুই অনেক স্পেশাল। ঈদের পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে প্রতিবার একটা ব্যাগ কেনা হতো। শুধু ঈদি (সালামি) সংরক্ষণ করাই ছিল ওই ব্যাগের কাজ। ফলে ওই ব্যাগটার মেয়াদ থাকত তিন দিন। সব মিলে দেড় শ–দুই শ টাকা হতো তাতে। সেই টাকা নিয়ে আমার সে কী আনন্দ। ঈদের দিন সকালবেলা ঈদি সংগ্রহ করে বের হতাম শখের জিনিসপত্র কিনতে।’
এখন কনা ঈদ উপলক্ষে বেশ কিছু পোশাক উপহার পান। সারা বছরই চলে টুকটাক কেনাকাটা। ঈদের আগে নানা আয়োজন-অনুষ্ঠানে পরে ফেলা হয় পোশাকগুলো। তাই ঈদের দিন সবচেয়ে সাধারণ পোশাকটা পরে ঈদ কাটান।
সেবার ঈদে চাঁদ ওঠেনি
গায়ক ইমরান বড় হয়েছেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়ায়। দুই বোন, এক ভাইয়ের ভেতর ইমরান ছোট। ইমরানরা সব সময় ঈদের চাঁদ দেখে তারপর ঈদের কেনাকাটা করতে বের হতেন। চাঁদরাতে কেনাকাটার নাকি মজাই আলাদা। তো, একবার ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় চাঁদ ওঠেনি। সবাই ভাবল, পরদিন ঈদ হবে না। কিন্তু রাত ১০টায় মাইকিং করে জানানো হলো, ‘ঈদের চাঁদ দেখা গেছে, আগামীকাল ঈদ।’ তাই শুনে সবার তো আক্কেলগুড়ুম, কেউ কেউ আবার কান্নাকাটিও জুড়ে দিল। কেননা ঈদের পোশাক তো কেনা হয়নি। আর নতুন পোশাক ছাড়া ঈদ হয় নাকি? তারপর কী হলো জানিয়ে ইমরান বলেন, ‘রাত ১১টার পর আমার আম্মু, আব্বু, চাচা ও চাচিরা সবাই আমাদের পাঞ্জাবির মাপ আর আপুদের একটা করে ড্রেস নিয়ে বের হলেন। নতুন পোশাক নিয়ে তাঁরা ফিরলেন ভোররাতে। সেই রাতে আমরা সবাই জেগে ছিলাম।’ ইমরান বলেন, ‘আগে ঈদের পোশাক বারবার বের করে দেখতাম। ঘ্রাণ নিতাম। আবার তুলে রাখতাম। এখন সেই ফিলটা আর পাই না। আসলে নব্বইয়ের দশকে ছেলেবেলা কাটানো মানুষেরা অনেক ভাগ্যবান। এখন ঈদের সেই ম্যাজিকটাই হারিয়ে গেছে।’
ইদানীং ইমরানের ঈদ কাটে ব্যস্ততায়। এখন দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারলেই মনে হয় ঈদটা পরিপূর্ণ হয়েছে। এখন তো বড় বোনেরাও ইমরানের কাছ থেকে সালামি নেয়!
ঈদের দিনে পানিবন্দী বাঁধন
আজমেরী হক বাঁধনের বাবার ছিল বদলির চাকরি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে বাঁধনের ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। তবে নিয়ম করে রোজার ঈদ হতো নানিবাড়ি, ঢাকার রায়েরবাজারে। আর কোরবানির ঈদে যেতেন দাদাবাড়ি, মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগরে। মামাতো, ফুফাতো ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন—সবাই মিলে ঈদ করতেন। ঈদের জামা–জুতা নিয়ে উত্তেজনার অন্ত থাকত না বাঁধনের। কেননা তখন দুই ঈদের পোশাক দিয়েই সারা বছরের সব অনুষ্ঠানে যেতে হতো। ঈদ ছাড়া সারা বছরে ‘পার্টি ড্রেস’ কেনা হতো না বললেই চলে।
১৯৯৭ সালের ঘটনা। একবার ঈদের সময় ভীষণ বন্যা হলো। বাঁধনরা সেবার ছিলেন ভোলায়। সংগত কারণেই বাঁধনের বাবা সেই সময় ‘স্টেশন লিভ’ করতে পারেননি। ফলে বাঁধনদের ঈদ করতে হয় ভোলায়, দোতলার একটি বাড়িতে। ঈদের দিন সেই বাড়িতে নিচতলায় হাঁটু পর্যন্ত পানি উঠে গিয়েছিল। ফলে বেড়ানো তো দূরের কথা, ঘর থেকেই বের হতে পারেননি, পানিবন্দী কেটেছিল সেবারের ঈদ।
এখন ঈদে আপনজনদের উপহার দেন, সালামি দেন, জাকাত-ফিতরা দেন। এবার ঈদে বাঁধন নিজের যেমন জন্য কিছুই কেনেননি। তবে উপহার পেয়েছেন কয়েকটি। ঈদের দিন মা-মেয়ে মিলিয়ে পরবেন বন্ধুর ফ্যাশন হাউস রঙিন পিরানের পোশাক।