ঢাকা শহরের সেই সাত মাঠের কলোনি
মোজাইক, টাইলস, স্লাইডিং জানালা—কিছুই ছিল না। তারপরও আসাদগেট নিউ কলোনির ৯ নম্বর বিল্ডিংটার জন্য এখনো কেন মন কেমন করে। ৭০–৮০র দশকের কলোনির দিনগুলোতে ফিরে গেলেন লেখক
সাতটা বিল্ডিংয়ের সামনে একটা করে মাঠ। অনেকটা সেই গানের মতো করে বলি, নীড় ছোট ক্ষতি নেই, ‘মাঠ’তো বড়! আর সবচেয়ে বড় মাঠটা ছিল আমাদের ৯ নম্বর ভবনের সামনে। (সেই পুরোনো বিল্ডিং ভেঙে এখন নতুন ভবন হয়েছে)। বলছিলাম সত্তর–আশির দশকে ঢাকার আসাদগেট নিউ কলোনির কথা। যেখানে কেটেছে আমার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। মায়ের চাকরির সূত্রে সেখানে থাকা।
কলোনির ছোট্ট বাসা। কিন্তু ডুপ্লেক্স (দুটি বিল্ডিং ছিল ডুপ্লেক্স)। যাঁরা আমাদের মতো একতলা–দোতলায় থাকতেন, তাঁদের বাড়তি পাওয়া ছিল সামনের ছোট্ট একটা বাগান। তাতেই মাথা নোয়াবার নয় কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকত বিশাল এক পাম গাছ। বাঁশের বেড়া আঁকড়ে নির্লজ্জের মতো বেড়ে উঠত মাধবীলতা। গোলাপি রঙের টাইগার লিলি, সাদা লিলি, টগর, হাসনাহেনার পাশাপাশি শীতকালে টমেটো চাষও বাদ যায়নি। গিজার তো ছিল না, কেরোসিন বা গ্যাসের চুলায় গরম পানি কতবার আর করা যায়? শীতকালে এই বাগানে বালতিতে গোসলের পানি গরম করা থেকে শুরু করে লেপ–তোষক রোদে দেওয়া, রোদ পোহানো—সবই হতো। তবে সবই যে কবিতার মতো রোমান্টিক ছিল, তা কিন্তু না। ভারী বৃষ্টিতে মাঠ উপচে রাস্তায় উঠত পানি, অতঃপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে বাড়তে বাড়তে একতলার ঘরেও ঢুকেছে কতবার। সে এক ভোগান্তি।
নিচতলায় বসার ঘর, রান্নাঘর, একটি টয়লেট, সিঁড়ির নিচের জায়গায় খাবার ঘর, ছোট্ট বারান্দা। দোতলায় দুটি শোবার ঘর। একটি বড়, একটি ছোট। একটি টয়লেট, ছোট্ট বারান্দা। ব্যস। মোজাইক, টাইলস, স্লাইডিং জানালা—ছিল না কিছুই। কিন্তু আলো–বাতাসের কমতি ছিল না। ছোট্ট বাড়ির বরকতও ছিল অনেক। মা–বাবা, আমরা দুই ভাই–বোন তো ছিলামই; দাদু, নানু, মামা, খালা মিলে ভরা হাট। এর মধ্যে অমুকের চোখের অপারেশন, তমুকের বাচ্চার পেটে ব্যথা, গ্রাম থেকে কেউ না কেউ এসে উঠতই। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনের কনে দেখা; হলে থাকা ছাত্রের পরীক্ষার প্রস্তুতি; অনিবার্য কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর বাক্সপেটরা নিয়ে চলে আসা লেগেই ছিল। এমনকি জাপানি তরুণীর বাঙালি পরিবারে তিন মাস থাকার আতিথেয়তাও বাদ যায়নি!
বসার ঘরের আসবাব সরিয়ে রাতে কার্পেটের ওপর টানা বিছানা, ভোর হতে না হতেই টিপটপ। পরপর তিনটি জানালার পর্দা সরানো, শিক গলিয়ে নরম রোদ ডিভানের নকশিকাঁথার ওপর তেছরা করে পড়ত। ঘরের মাঝে কালো গোলটেবিলের ওপর চিনামাটির পাত্রে মায়ের হাতের ইকেবানাও তৈরি।
কলোনিতে বড় হওয়া এই আমি শিখেছি অনেক কিছুই। শবে বরাতের বিকেলে এক বাড়ির হালুয়া অন্য বাড়িতে দেওয়া, কোরবানির মাংস সংবাদপত্রে প্যাঁচিয়ে ছোট ছোট ভাগ করে প্রতিবেশীদের দেওয়া। কারও বাড়িতে ফ্রিজ নেই কিন্তু বাসায় এসেছে বড় মাছ বা অনেকটা মাংস—প্যাকেটের ওপর নাম লিখে দিয়ে যেতেন। মা হাসি মুখে রেখে দিতেন যত্নে। সবার ঘরে তো ল্যান্ডফোন ছিল না তখন, দেশ–বিদেশ থেকে আত্মীয়স্বজন ফোন করলে বাড়ির বাচ্চারা দৌড়ে গিয়ে ডেকে আনত তাঁদের। তাঁরা ওপরের ঘরে গিয়ে ফোন ধরতেন, প্রাইভেসিতে টনটনে এই আমরাই বরং তাঁকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে অন্য ঘরে চলে যেতাম। আরেকটা কথা খুব গভীরে মনে আছে, দুপুরে কেউ বাড়িতে এলে তাঁকে কখনোই জিজ্ঞেস করা হতো না, ‘খাবেন?’ বরং সরাসরি বলা হতো, ‘হাত ধুয়ে বসে পড়ুন।’ তারপর অতিথিকে সমাদর করে ভাগেযোগে খাওয়া।
ভাবলে অবাক লাগে, এই ছোট্ট বাড়িতেই কারও চিকেন পক্স হয়েছে তো তার জন্য একটা ঘর ছেড়ে দেওয়া ২১ দিনের জন্য; বাবা পিএইচডি করেছেন দুই বছরের ছুটি নিয়ে, তাঁর গবেষণার জন্য নিরিবিলি জায়গার ব্যবস্থা করা; খালার গায়েহলুদ, বসার ঘরেই মঞ্চ–আলপনা করা, ছোট্ট রান্নাঘরেই তৈরি হচ্ছে জনা ৫০–এর জন্য পরোটা, মাংস, পায়েস, ফুলপিঠা…।
সাত মাঠের এক মাঠে তৈরি হয়েছিল শহীদ মিনার। ২১ ফেব্রুয়ারিতে সেই মিনারে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গাইতে গাইতে কলোনির ছেলেমেয়েরা ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতো প্রতিবছর। বাবা–মায়ের কর্মক্ষেত্রের, নানা সংগঠনের বৈঠক হয়েছে এই ছোট্ট বাড়িতে। কত নামকরা বিনয়ী মানুষ বেতের মোড়া টেনে বসে ঘরের নাশতা–চা খেয়ে গেছেন। কলোনির ছোট্ট বাড়িতে অমুক আসছেন বলে আমাদের এতটুকুও সংকোচ হতো না। এমন বৈঠক হলে বরং আমরা ছোটরা অধীর আগ্রহে সিঁড়ির নিচে অপেক্ষা করতাম, অতিথি বিদায় হলেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম বেঁচে যাওয়া চা–নাশতার ওপর। শেষ যেদিন এই কলোনির বাসা ছেড়ে আমরা নিজেদের বাড়িতে গেলাম, সেদিন বুক ভাসিয়ে কেঁদেছিলাম। তখনকার বেবিট্যাক্সি (অটোরিকশা) থেকে বারবার পেছন ফিরে দেখছিলাম। জানি, নতুন বাড়িতে আমার জন্য একটা আলাদা ঘর হয়েছে, তবু। মনে হচ্ছিল, আমি ফেলে যাচ্ছি বড় আপন কিছু। আপন তো বটেই। নিজের শৈশব–কৈশোরের চাইতে আপন আর কী আছে!
নিজের সংসার, পেশাজীবনে ব্যস্ত সময়। চাইলেও সময় বের করে সব আমন্ত্রণে যাওয়া যায় না। সব ইচ্ছা পূরণ করা যায় না। কিন্তু যখন শুনলাম নিউকলোনির ৯ নম্বর বিল্ডিংটা ভেঙে আবার নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে, একদিন গোধূলিবেলায় আমি ঠিক গিয়ে একা একাই দেখে এসেছিলাম আমার সেই পরিচিত কলোনি, বড় মাঠকে। যে মাঠে প্রতি রোববার (তখনকার ছুটির দিন) কলোনির ছেলেরা ক্রিকেট খেলত, ‘খেলাঘর’ থেকে হতো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কিংবা রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর।
অদ্ভুত অচেনা লাগছিল। লাগবেই তো—দিন যায়, কথা থাকে।