যে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও অঞ্চল হারিয়ে যেতে পারে বিশ্বের মানচিত্র থেকে
কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। গলছে বরফ। বাড়ছে সমুদ্র, নদীর পানি, তথা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া এবং পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে নতুন গবেষণা অতীতের সব আশা ভেঙে দিচ্ছে। নেচার কমিউনিকেশনসে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ক্লাইমেট সেন্ট্রাল পরিচালিত নতুন গবেষণা বলছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যা ধারণা করা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে সেটা হতে পারে তিন গুণের বেশি। এ গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানের কথা উঠে এসেছে, যেসব ২০৫০ সালের মধ্যে ‘হাওয়া’ হয়ে যেতে পারে মানচিত্র থেকে। কারণ, গবেষকেরা বলছেন, এসব স্থান তলিয়ে যেতে পারে পানির নিচে। আর এসব স্থানের জনসংখ্যা কমপক্ষে ২০ কোটি। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সেখানকার জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। তাই ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও কম। অন্যদিকে জনবহুল দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকির আশঙ্কাও বেশি। বিশ্বের কোন জনবহুল স্থান সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ? চলুন, জেনে নিই।
১. ভিয়েতনামের দক্ষিণাঞ্চল
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা ইতিমধ্যে ভিয়েতনামকে ‘দ্য নেক্সট এশিয়ান টাইগার’ আখ্যায়িত করতে শুরু করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনাম। শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে তারা অন্য দেশের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে। অথচ পরিবেশ বিপর্যয়ের যেকোনো মানদণ্ডে এই দেশ, বিশেষ করে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল আছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। ভিয়েতনামের সমুদ্রতটরেখা উত্তরে চীন সীমান্ত থেকে শুরু করে দক্ষিণে থাইল্যান্ড উপসাগরে কম্বোডিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। লম্বায় ৩ হাজার ৪৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। ফলে ভিয়েতনাম, চীন আর থাইল্যান্ডের সমুদ্র-তীরবর্তী এসব অঞ্চল ঝুঁকিপূর্ণ। আর সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় এসব অঞ্চলেই গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র, বিনোদন ও বাণিজ্যের কেন্দ্র তথা অর্থনৈতিক অঞ্চল। ২০২৪ সালের হিসাব অনুসারে, ভিয়েতনামে প্রায় ১০ কোটি মানুষের বাস। হো চি মিন শহর এই দেশের অর্থনীতির কেন্দ্র। অথচ ধারণা করা হচ্ছে, দ্রুত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা রোধে বড় কোনো উদ্যোগ না নিলে এই শহরও তলিয়ে যেতে পারে পানির নিচে।
২. থাইল্যান্ডের পাতায়া
থাইল্যান্ডের পাতায়া সমুদ্রসৈকত মধুচন্দ্রিমার জন্য বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় স্থান। এই শহরের রাতের সৌন্দর্যের টানে প্রতিবছর ৯৪ লাখ পর্যটক ভিড় করেন। পাতায়াসহ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের দক্ষিণাঞ্চলের একটা বড় অংশ হারিয়ে যেতে পারে বিশ্বমানচিত্র থেকে।
৩. চীনের উপকূলীয় এলাকা
গবেষণায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, চীনের নগর উপকূলীয় ভূমির এক-চতুর্থাংশ ১০০ বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে তলিয়ে যেতে পারে। দেশটির প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হো চি মিন শহরের অবস্থানও এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ভেতর।
৪. যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স
যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা রাজ্যে মিসিসিপি নদীর পাড়ের সবচেয়ে জনবহুল শহর নিউ অরলিন্স। বিস্তৃত উপসাগরীয় উপকূল অঞ্চলের জন্য এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। শহরটিতে গড়ে উঠেছে বিশাল চায়না টাউন, ফ্রেঞ্চ মার্কেট, সিসিলিয়ান মার্কেট, সেন্ট মেরি মার্কেটসহ বড় বড় বাজার। বহুভাষী, বহুবর্ণের মানুষের মিলিত প্রচেষ্টায় নিউ অরলিন্স অনন্য এক পর্যটন নগরী হিসেবে প্রসিদ্ধ। ২০০৫ সালের আগস্টে ক্যাটরিনা হারিকেনের আঘাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শহরটি। সে সময় এ অঞ্চলের ৮০ শতাংশের বেশি অঞ্চল প্লাবিত হয়। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়। জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ কমে আসে। গত দুই দশকে আরও কয়েকটি ছোটখাটো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে সেই ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে আনলেও সাড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষের শহরটি এখনো রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।
৫. ভারতের মুম্বাই
আরব সাগরের তীরবর্তী শহর মুম্বাইও আছে এ তালিকায়। ২ কোটির বেশি মানুষ বাস করে মুম্বাইয়ে।
৬. মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া
যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৩৩০ বছর আগের প্রতিষ্ঠিত শহর আলেকজান্দ্রিয়াও আছে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায়। ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে প্রায় ৩২ কিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা এই নগরী মিসরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এখানেই মিসরের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। আর ঠিক এ কারণেই এটি শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে সুয়েজ খাল হয়ে আসা প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের পাইপলাইনও আছে। ৬০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে এই শহরে।
৭. ইরাকের বসরা
ইরাকের বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে বসরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ইসলামের ইতিহাস, স্থাপত্যের দিক থেকেও সমৃদ্ধ পারস্য উপকূলের ১৪ লাখ মানুষের এই শহর।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক, পরিবেশবিষয়ক লেখক ও জেনেভার ওয়েবস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক দিনা আইনেস্কো জানান, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর মানুষ সময়ের সঙ্গে বাস্তুচ্যুত হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব খাত হবে ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভূরাজনৈতিক, খাদ্য ও চিকিৎসাসংক্রান্ত নানা ধরনের অস্থিরতা ও সংকট দেখা দেওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র। এমনকি দুর্ভিক্ষ বা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ‘নিছক পরিবেশ বিপর্যয়’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস