অজান্তেই নিজের সঙ্গে টক্সিক আচরণ করছেন না তো?
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের একটা নারী চরিত্রের কথা বলি। রাতে বিছানায় ঘুমাতে গিয়ে তার পানির পিপাসা পেয়েছে। তখন সে নিজেই নিজেকে বলে, এখন যদি তার জীবনসঙ্গী পানি চাইত, সে উঠে গিয়ে তাকে গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির কণা জমা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিত। এমনকি টুকটাক কাজের জন্য যে ছেলেটি রয়েছে তারও যদি পানির পিপাসা পেত, সে উঠে গিয়ে পানি দিত। কিন্তু নিজের পানির পিপাসা পেয়েছে, কিছুতেই উঠে পানি খেতে ইচ্ছা করছে না!
ছোটবেলা থেকেই আমাদের অন্যের প্রতি সহনশীল হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। নারীদের স্বামী আর সন্তানদের প্রতি যত্নশীল হওয়ার কথা আশপাশের মানুষেরাই ক্রমাগত মনে করিয়ে দিতে থাকেন। বলা হয়, ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। পারিবারিক, সামাজিক ও নানা করণে অনেক সময় আমরা অন্যের প্রতি সদয় হওয়ার চেষ্টা করলেও নিজের প্রতি সহনশীল হওয়ার বিষয়টি অবহেলা করে যাই অজান্তেই। কখনো কখনো না জেনেই আমরা দিনের পর দিন নিজের সঙ্গে টক্সিক আচরণ করি। চলুন জেনে নিই ‘টক্সিক’ আচরণের কিছু লক্ষণ। আর মিলিয়ে নিন নিজের সঙ্গে।
১. আপনি কি ‘পারফেকশন’—এর ফাঁদে পা দিয়েছেন
আপনার কি সব সময় ‘পারফেক্ট’ হতে ইচ্ছা করে? কোনো কাজ ঠিকমতো করতে না পারলে নিজেকে মনে মনে দোষারোপ করেন? ‘পারফেক্ট’ ধারণাটাই একটা মিথ। আমরা কেউ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নই। নিজের ভুল ধরার পর আপনি যদি অত্যধিক সমালোচনা করেন, তবে তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি আপনার আত্মবিশ্বাসও কমিয়ে দেয়। তাই নিজের প্রতি সদয় হোন। নিজেকে ক্ষমা করে দিন। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোন।
২. ‘হিরো কমপ্লেক্স’
যদি মনে করেন, আপনার কোনো আবেগপ্রবণ সমর্থনের দরকার নেই, আপনি নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট, তাহলে ভুল। আবেগপ্রবণভাবে আমরা সবাই কখনো না কখনো দুর্বল অনুভব করি। এই সময় আপনি কাছের মানুষদের কাছে নিজের মনের অবস্থা খুলে বলুন। হালকা হোন। সব আবেগের ভার একা বহন করতে থাকলে একসময় মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। কোনো কিছুতেই আগের মতো আর উদ্যম পাবেন না।
৩. নিজেকে ‘ফর গ্রান্টেড’ হিসেবে নেওয়া, নিজের যত্ন না নেওয়া
সব সময় অন্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, নিজের যত্ন না নেওয়া, ব্যর্থতাকে ভয় পাওয়া, আত্মবিশ্বাসহীনতা, দায়িত্ব এড়ানো, কঠিন পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে দেওয়া—এসব বৈশিষ্ট্য যদি আপনার মধ্যে থাকে, তবে তা থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসুন। নিজেকে জানুন। নিজের মেধা আর শক্তিশালী দিকগুলোকে বিকশিত করুন। আস্থা রাখুন নিজের ওপর। নিজেই হোন নিজের সেরা বন্ধু।
৪. অনুভূতি প্রকাশে অনীহা
কেউ নিজের অনুভূতি প্রকাশের ব্যাপারে চাপা স্বভাবের হয়ে থাকেন। সামনের ব্যক্তি অযৌক্তিক কথা বললেও নিজের যুক্তি বা অনুভূতি প্রকাশ করেন না। নীরবে মেনে নেন। প্রেম-ভালোবাসা, ক্ষোভ, দ্বিমত—কোনো কিছুই প্রকাশ করতে চান না। এটা নিজের প্রতি অবিচার। আবেগ প্রকাশ না করার চাপ আমাদের বিষণ্ন করে তোলে, মানসিক অবসাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে কখনো ঘটতে পারে আবেগপ্রবণ বিস্ফোরণ। তাই আপনার আবেগ-অনুভূতিকে উপেক্ষা না করে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করুন, প্রিয়জনদের সঙ্গে ভাগ করুন।
৫. অতীত নিয়ে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না?
আমাদের জীবনে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। আমরা ভুল করি। ব্যর্থ হই। তবে এ জন্য জীবন থেমে থাকে না। আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। এ জন্য নিজেকে বাকি জীবন সচেতন আর অবচেতনভাবে যদি দোষারোপ করতে থাকেন, তার মানে আপনি নিজের সঙ্গেই টক্সিক আচরণ করছেন। ‘আমি ব্যবসায় লস করেছি, আমাকে দিয়ে ব্যবসা হবে না’, ‘সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল, আমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না’ বা ‘আমি আর কাউকে কখনো বিশ্বাস করতে পারব না’—এ ধরনের চিন্তা আমাদের জীবনে এগোতে দেয় না। নেতিবাচকতার দুষ্টচক্রে ছুড়ে ফেলে।
৬. লোকে কী বলবে?
এই চিন্তায় আমরা অনেকেই নিজের স্বাভাবিক সত্তা হারিয়ে ফেলি। মনের কথা শুনি না। নতুন কিছু করতে ভয় পাই। নিজেকে গুছিয়ে নিই। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’—এ ভয়ে অনেকে নিজেকে ঠিকভাবে প্রকাশ করে না, আবার কখনো গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হারাতেও পিছপা হয় না। লোকে কী বলবে, এই ভেবে থেমে থাকবেন না। এগিয়ে যান। নিজেকে মেলে ধরুন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
৮. নিজের সঙ্গে নেতিবাচক কথোপকথন
আপনি কি যেকোনো বিষয় নিয়ে ‘নেগেটিভ সেলফ-টক’ করতেই থাকেন? অতিরিক্ত ভাবনা, দুশ্চিন্তা মনের কোণে উঁকি দিতেই থাকে? অজানা আশঙ্কাকে মনের অন্দরে ঠাঁই দেন? যা ঘটে গেছে, সেটাকে চলে যেতে দিন। মনে রাখবেন, খারাপ দিন বলে কিছু নেই। হয় দিনটা একটা ভালো স্মৃতি দেবে, অথবা একটা ভালো শিক্ষা।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া