একজন রোগী যখন তোমার সামনে দাঁড়ায়, তখন তুমিই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ
২৬ মে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সমাবর্তন বক্তা ছিলেন মার্কিন নিউরোসার্জন, সাংবাদিক ও লেখক সঞ্জয় গুপ্ত।
পছন্দ করো বা না করো, ভবিষ্যতে চিকিৎসা পেশায় যুক্ত হও বা না হও, আজ থেকে তোমার পরিচয়—তুমি একজন ডাক্তার। প্রতিবেশীদের কাছেও তুমি ডাক্তার হিসেবেই পরিচিতি পাবে। কারও বাড়ির উঠানে যখন বারবিকিউ পার্টি হবে, সেখানেও তোমাকে আজব সব প্রশ্ন শুনতে হবে। কারও পিঠব্যথা, কারও গায়ে ফুসকুড়ি, কেউবা সন্তান জন্মদানে অক্ষম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করবে, হঠাৎ করেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে মানুষ আরাম বোধ করছে। নিজের নতুন এই চরিত্রকে স্বাগত জানাও। সংকোচ কোরো না।
অনেকে আবার যত সমস্যাই হোক, তোমার কাছে আসবে না। যেমন আমার তিন সন্তান। অসুখবিসুখ যা-ই হোক, ওরা প্রথমে যায় মায়ের কাছে। অথচ মা একজন আইনজীবী!
আমি তোমাদের খুব বেশি চাপে ফেলতে চাই না। কিন্তু এটা সত্যি যে তোমার কাজ, তোমার ভূমিকা এখন সমাজের জন্য অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমার মতে, তোমরাই এখন ‘গার্ডিয়ান অব দ্য গ্যালাক্সি’। এ ব্যাপারেই আজ কিছু কথা বলব।
৩০ বছর আগে আমি মেডিকেল স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছি , এর মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে। মানুষ এখন আমাদের ওপর যতটা আস্থা রাখে, ততটাই সন্দেহ করে। আমরা স্বাধীনতাকে যতটা গুরুত্ব দিই, ততটাই ভয়ে বাঁচি। ৩০ বছর আগে যেসব রোগ ঠিক বুঝতাম না, এখন সেগুলো যে শুধু বুঝি, তা–ই নয়, নিরাময়ও করতে জানি। অথচ যাদের প্রয়োজন, সবাইকে এই চিকিৎসা দিতে পারি না।
তোমরাই পরিবর্তন আনতে পারো। তোমরাই পারো আস্থা ফেরাতে, রীতি বদলাতে। জীবনে এমন কিছু সময় আসবে, যখন তুমি দ্বিধায় পড়ে যাবে। জানবে, এই পৃথিবীতে তোমার উদ্দেশ্যটা অনেক বড়। কিন্তু এর সঙ্গে কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। তোমাকে চিকিৎসার ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে, এই সেবার প্রসারে ভূমিকা রাখতে হবে এবং সবচেয়ে বড় কথা—ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্কের পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে।
হলফ করে বলতে পারি, সমাজে এ রকম সম্পর্ক তুমি আর পাবে না। তোমাকে বিনয়ী হতে হবে। এই পেশার সুবিধাগুলো তুমি ভোগ করবে, কিন্তু কখনোই ঔদ্ধত্য দেখাবে না। একজন রোগী যখন তোমার সামনে দাঁড়ায়, সে হয়তো তোমাকে চেনেও না, কিন্তু সেই মুহূর্তে তুমিই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
একজন মানুষের সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্তে তার পাশে থাকা, মানুষটির নিজ শরীর যখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেছে, তখনো তাকে আগলে রাখা, প্রয়োজনে তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া; কিন্তু এই ভরসা দেওয়া যে ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে ঠিকই ফিরিয়ে আনব—এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কিছুই হতে পারে না। যখন তোমাদের অবস্থায় ছিলাম, এটা কখনো বুঝতাম না।
ডা. কার্চমার বলেছিলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতেই সঠিক সিদ্ধান্ত হলো সদয় হওয়া। তাৎক্ষণিকভাবে তোমার হয়তো অন্য কিছু মনে হতে পারে, তুমি হতাশ হয়ে উঠতে পারো, বিরক্ত হতে পারো। কিন্তু যদি সদয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নাও, তাহলে সব সময়ই দিন শেষে ভালো বোধ করবে। মনে রেখো, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে মানবিক পেশা। হাসো, হাসাও। যেমনটা মায়া আঞ্জেলো বলেছেন, তুমি কী বলেছ বা কী করেছ, সেটা হয়তো লোকে মনে রাখবে না। শুধু মনে রাখবে, তুমি তাকে কী অনুভূতি দিয়েছ।
তুমি বুদ্ধিমান—জীবনটা এটা প্রমাণ করার পেছনে পার করে দিয়ো না। ইতিমধ্যেই এটা প্রমাণিত। তুমি বরং জ্ঞানী হওয়ার পেছনে সময় দাও। একজন বুদ্ধিমান মানুষ সঠিক উত্তরটা জানে। কিন্তু একজন জ্ঞানী মানুষ জানে, সঠিক প্রশ্নটা কী। অতএব সঠিক প্রশ্নটা খুঁজে বের করো, সেটা যতই বোকার মতো শোনাক না কেন। কারণ, সঠিক প্রশ্ন করার সাহস সবার থাকে না। (সংক্ষেপিত)