ফ্রিজে খাবার কীভাবে রাখবেন
হররোজ বাজার করার ঝক্কি থেকে মুক্তি দিয়েছে ফ্রিজ। তবে ঠিকঠাক নিয়ম জানা না থাকলে ফ্রিজের সর্বোচ্চ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন আপনি। সময়সীমার আগেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে খাবার। কিংবা হারিয়ে যেতে পারে খাবারের সুঘ্রাণ। তা ছাড়া ডিপ ফ্রিজে নিয়ম না মেনে খাবার রাখলে প্রয়োজনের সময় কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি খুঁজে পাওয়াও মুশকিল হয়ে পড়ে। কোন খাবার কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, তা জানা যেমন আবশ্যক, তেমনি ফ্রিজ কখন কীভাবে পরিষ্কার করতে হবে, সেটিও জানতে হবে। রান্নাবিদ সিতারা ফেরদৌস ও জেবুন্নেসা বেগম–এর কাছে ফ্রিজে খাবার সংরক্ষণ বিষয়ে বুদ্ধিপরামর্শ নিলেন রাফিয়া আলম
ফ্রিজে খুব চাপাচাপি করে অতিরিক্ত খাবার বোঝাই না করাই ভালো। পারলে কাঁচা মাছ-মাংস ডিপ ফ্রিজের একই তাকে রাখবেন না। মসলা ও সবজিও নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন। খাবার রাখার আগে ফ্রিজের তাকে পুরু প্লাস্টিকজাতীয় কিছু (রেক্সিনও হতে পারে) বিছিয়ে দিন। ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষিত কাঁচা খাবারের প্যাকেটের গায়ে নাম লেখা থাকলে সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। নিয়মমাফিক ফ্রিজ পরিষ্কার রাখা খাবার ভালো রাখার পূর্বশর্ত।
চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক, ফ্রিজে কোন খাবার কীভাবে সংরক্ষণ করবেন—
কাঁচা খাবার সংরক্ষণ
কাঁচা খাবার প্যাকেট করতে পুরু পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করা উচিত। একবার ব্যবহার করা প্যাকেট দ্বিতীয়বার ব্যবহার না করাই ভালো।
প্যাকেটে যাতে বাড়তি বাতাস রয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
প্যাকেটের ভেতর অল্প করে কাঁচা খাবার রাখুন, যাতে একটা খামের মতো করে সেটিকে মুড়ে দেওয়া যায়। এভাবে রাখা হলে ফ্রিজের জায়গাটুকু ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়।
ডিপ ফ্রিজে প্যাকেট রাখার তিন-চার ঘণ্টা পর বরফ জমে গেলে প্যাকেটগুলো একটু নেড়েচেড়ে উল্টেপাল্টে রাখুন। তাহলে পরবর্তী সময়ে প্যাকেট বের করতে সুবিধা হবে।
কাঁচা মাংস সংরক্ষণ
গরু, খাসি, ভেড়া প্রভৃতির মাংসের বিভিন্ন অংশ আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা উচিত। তাহলে রান্নার সময় সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে। পশু বা পাখি জবাই করার তিন-চার ঘণ্টা পর মাংস ফ্রিজে ওঠাতে হবে। মাংস ফ্রিজে রাখার আগে ধোয়া উচিত নয়। ফ্রিজে তোলার আগে অন্য কোথাও থেকেও যাতে মাংসের ওপর পানি না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। এই তিন-চার ঘণ্টা সময়ের মাঝে মাংসের ভেতরকার পানি ঝরানোর জন্য ঝাঁঝরিতে রাখা ভালো। এ সময় ফ্যান ছেড়ে দিলে সহজেই মাংসের ভেজা ভাব দূর হবে। মাংসের চর্বি ফেলে ছোট ছোট টুকরা করে নিয়ে ফ্রিজে ওঠানো ভালো। হাড় বা শক্ত অংশের প্যাকেট ডিপ ফ্রিজের নিচের দিকে রেখে ওপরে মাংস বা নরম অংশের প্যাকেট বিছিয়ে দিন। সংরক্ষিত মাংস তিন মাসের মধ্যে খেয়ে নেওয়াই ভালো।
কাঁচা মাছ সংরক্ষণ
মাছ সংরক্ষণ করতে হবে চটজলদি। বাজার করে আনার পর প্রথম কাজই হবে মাছ ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলা। এরপর পানি ঝরিয়ে ফ্রিজে তুলে রাখুন। ছোট ও মাঝারি মাছ গোটা সংরক্ষণ করাই ভালো। বড় মাছ টুকরা করে রাখুন। মাছের টুকরায় লবণ, হলুদ ও সাদা সিরকা (কিংবা লেবুর রস) মাখিয়ে রাখতে পারেন। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হলে মাছ ভালো থাকে মাসখানেক। ফ্রিজে মাছের গন্ধ এড়াতে কয়েক টুকরা লেবু রেখে দিতে পারেন। শুকিয়ে গেলে পুরোনো লেবুর টুকরা বদলে ফেলে নতুন টুকরা রেখে দিন।
কাঁচা সবজি ও শাক সংরক্ষণ
শাক ও সবজি ফ্রিজে তোলার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে পুরোপুরি শুকনা থাকে। এগুলো তাজা রাখতে বিক্রেতারা অনেক সময়ই পানি ছিটিয়ে রাখেন। ফ্রিজে তোলার সময় খেয়াল রাখুন, এগুলোতে কোনো পানি যাতে না থাকে। শাক বা সবজির গায়ে ময়লা থাকলে ফ্রিজে রাখার আগে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর পানি ঝরিয়ে, পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে ফ্যানের নিচে শুকিয়ে ফেলা ভালো।
শাকসবজির নির্দিষ্ট জিপার ব্যাগেই শাকসবজি রাখা ভালো। পলিথিনের প্যাকেট ব্যবহার করলে ছিদ্র করে নিন, তাহলে ভেতরটা সহজে আর্দ্র হবে না। এভাবে সবজি পাঁচ-ছয় দিন ভালো থাকে।
কপিজাতীয় সবজি ডাঁটা ফেলে টুকরা করে এক চা–চামচ করে লবণ ও ভিনেগারমিশ্রিত পানির গামলায় রেখে দিন মিনিট দশেক। এরপর কলের পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে শুকনা অবস্থায় প্যাকেট করে ফ্রিজে রাখুন। সপ্তাহখানেক ভালো থাকবে। একই পদ্ধতিতে গোটা টমেটো সংরক্ষণ করা যায় সপ্তাহ দুয়েক।
লাউ-কুমড়া না ধুয়ে একেকটি ফালি সেলোফেন কাগজে মুড়ে রাখলে পাঁচ-ছয় দিন ভালো থাকে।
ক্যাপসিকাম বা বেলপেপার ধুয়ে শুকিয়ে গোটা অবস্থায় সেলোফেন কাগজে মুড়ে রাখলে প্রায় মাসখানেক ভালো থাকে।
কাঁচা মরিচ ধুয়ে বোঁটা ফেলার পর কিচেন টাওয়েলে বিছিয়ে পানি শুকিয়ে ফেলুন। এরপর শুকনা টিস্যু পেপারে মুড়ে বক্সে করে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন ২০ থেকে ২৫ দিন।
শাক ধোয়ার পর পানি ঝরিয়ে প্রয়োজনমাফিক টুকরা করে পাতলা কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে রাখুন। পানি শুকালে ফ্রিজে রাখুন। এভাবে দুই থেকে চার দিন খাওয়ার উপযোগী থাকে।
বিভিন্ন শাকসবজি আলাদা প্যাকেটে রাখুন।
অনেক ফ্রিজে শাকসবজির জন্য ছোট ছিদ্রযুক্ত আলাদা ড্রয়ার থাকে, তাতেই শাকসবজির প্যাকেট রাখুন।
লম্বা সময়ের জন্য সবজি সংরক্ষণ করতে চাইলে গরম পানিতে পাঁচ মিনিটের জন্য সেদ্ধ করে নিতে হবে। এরপর ঝাঁঝরিতে পানি ঝরিয়ে নিন। বায়ুরোধী বক্স বা জিপ ব্যাগে করে ডিপ ফ্রিজে তুলে রাখলে এই সবজি এক মাস পর্যন্ত ভালো থাকে।
অন্যান্য পাতা কাঁচা সংরক্ষণ
ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, পার্সলেপাতাসহ নানান ধরনের পাতাও ফ্রিজে সপ্তাহখানেক ভালো থাকে। আস্ত পাতা ধোয়ার পর কিচেন টাওয়েলে ছড়িয়ে শুকিয়ে নিন। শুকনা অবস্থায় কাগজের প্যাকেটে কিংবা ছিদ্রযুক্ত পলিথিনে মুড়িয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন। তবে পলিথিন ব্যবহার করলে রোজ খেয়াল করতে হবে, পলিথিনের ভেতরটা ঘেমে যাচ্ছে কি না। সে ক্ষেত্রে পলিথিন বদলে দিতে হবে।
চাইলে ধনেপাতা বায়ুরোধী বক্সেও রাখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বক্সের ভেতরে প্রথমে টিস্যু পেপার বা কাগজের টুকরা বিছিয়ে নিতে হবে।
পেস্ট হিসেবে সংরক্ষণ
টমেটো পেস্ট করে ডিপ ফ্রিজে কিউব আকারে জমিয়ে নিন। কিউব জমাট বেঁধে গেলে একটি বক্সে ঢেলে নিন। এই বক্স ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন মাসখানেক।
ব্লেন্ড করা বা বাটা মসলা ফ্রিজে দুই দিন ভালো থাকে। তবে ডিপ ফ্রিজে রাখা যায় মাস দুয়েক পর্যন্ত। তবে এতটা লম্বা সময় সংরক্ষিত অবস্থায় থাকলে মসলার ঘ্রাণ কিছুটা কমে যায়। রান্নার সুঘ্রাণ নিশ্চিত করার জন্য টাটকা বাটা মসলা সবচেয়ে ভালো। ডিপ ফ্রিজে রাখতে হলে মসলার পেস্ট একটা পাতলা বক্সে রাখুন। জমাট বেঁধে গেলে ছুরি দিয়ে কেটে রাখুন। তাহলে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনমাফিক অংশ বের করতে সুবিধা হবে। চাইলে টমেটোর মতো নিয়মেও মসলার পেস্ট কিউব করে জমিয়ে নিতে পারেন। এরপর কিউবগুলো একটা বক্সে করে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন।
রান্না করা খাবার
রান্না করা খাবার ফ্রিজে এক-দুই দিনের বেশি ভালো থাকে না। তবে ডিপ ফ্রিজে দিন পনেরোর জন্য রেখে দেওয়া যায়। সবজি অবশ্য একটু জলদিই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর মাংস ভালোভাবে রাখা হলে ১৫ দিন পরও খাওয়ার উপযোগী থাকে।
রান্না করা খাবার ফ্রিজে বা ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যা খেয়াল রাখতে হবে—
ফ্রিজে ওঠানোর আগে খাবার অবশ্যই ভালোভাবে ঠান্ডা করে নিন। তবে ঠান্ডা হওয়ার পর বেশিক্ষণ বাইরে রাখা উচিত নয়।
খাবার রাখার জন্য মুখ আটকানো যায়, এমন পাত্র বেছে নিন।
কাঁচা পেঁয়াজ দেওয়া খাবার ফ্রিজে রাখবেন না। এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তাই যেদিন এমন খাবার তৈরি হবে, সেদিনই খেয়ে ফেলুন।