একই মঞ্চে নোবেলজয়ীর সঙ্গে বক্তব্য দিলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী সুরাইয়া
২ জুলাই রাতের খাবারের সময় এল সুখবর। আয়োজকদের একজন জানালেন, ‘৬৩৭ তরুণ বিজ্ঞানীর পক্ষ থেকে সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আপনাকে মনোনীত করা হয়েছে।’ নোবেলজয়ী ৩৬ জনের সঙ্গে ৬ দিন সময় কাটানোর সুযোগই তো বড় পাওয়া। সেখানে একই মঞ্চে নোবেলজয়ী কারও সঙ্গে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণও আসবে, সুরাইয়া কাজী ভাবতেও পারেননি।
আয়োজনটা ছিল জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের দ্বীপশহর লিনডাউয়ে। ৩০ জুন থেকে ৫ জুলাই সেখানে অনুষ্ঠিত হয় লিনডাউ নোবেল লরিয়েট (নোবেলজয়ী) সভার ৭৩তম আসর। সমাপনী দিনে নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম ডি ফিলিপসের সঙ্গে একই মঞ্চে বক্তব্য দেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী সুরাইয়া কাজী (২৯)। তিনি নোবেল পুরস্কার প্রদানের দেশ সুইডেনের লিনশপিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানের অর্গানিক ন্যানো অপটিকস বিষয়ে পিএইচডি করছেন। থাকেন সুইডেনের নরশপিং শহরে।
সপ্তাহজুড়ে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আসার অভিজ্ঞতা, নোবেলজয়ীদের কাছ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা, সভায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণে তাঁর চার বছরের প্রস্তুতির গল্পগুলোই শোনালেন তিনি। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে কথা হলো ১০ জুলাই।
লিনডাউ সভা কী
১৯৫১ সাল থেকে লিনডাউ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের সভা ছিল পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে। অংশগ্রহণের জন্য ৯০টি দেশ থেকে মনোনীত হন ৬৩৭ জন। সুইডেনের পাঁচ তরুণ পদার্থবিজ্ঞানীর একজন প্রতিনিধি হিসেবে সভায় যোগ দেন সুরাইয়া কাজী। নোবেলজয়ীদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের সেতুবন্ধ রচনাই এ সভার উদ্দেশ্য। যেন নোবেলজয়ীরা তাঁদের জ্ঞান ও ভাবনার রসদ নতুনদের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন। এবারের সভায় ৩৬ জন নোবেলজয়ীর মধ্যে ২৫ জন ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের আর ১১ জন রসায়নের। ১৯৭৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী ব্রায়ান ডি জোসেপফসনও অংশ নিয়েছিলেন। সভা শেষে পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯৫৫ সালে শুরু হওয়া ‘মাইনাউ ঘোষণা ২০২৪’–এ সই করেন ৩০ জন নোবেলজয়ী।
যেভাবে নিয়েছিলেন প্রস্তুতি
ঢাকার বাসিন্দা ডিপটি কাজী ও মাহমুদা পেয়ারীর তিন মেয়ের মধ্যে সুরাইয়া মেজ। বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। ছোট বোন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করছেন।
ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হন সুরাইয়া। ২০১৮ সালে তিনি স্নাতক হন। সে সময় প্রথম লিনডাউ সভার কথা শোনেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী ওই সভার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। নিজেকে তখন এ রকম সভায় যেতে আবেদন করার জন্য যোগ্য মনে হয়নি। এ ছাড়া সুইডেনের শীর্ষস্থানীয় উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার স্বপ্ন ছিল অগ্রাধিকার তালিকায়। ২০১৯ সালে সেই সুযোগও এসে যায়। উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে (ম্যাটেরিয়ালস ফিজিকস) স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপর একদিন সামনাসামনি দেখা হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ব্যারি ব্যারিশের সঙ্গে। তিনি উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিতে এসেছিলেন। তাঁকে দেখার পর লিনডাউ সভার বিষয়টি আবার মাথায় আসে। সেই আগ্রহ আরও বাড়ে আরেক ঘটনায়। ২০১৯ সালে নোবেল কমিটি যখন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করে, তখন বক্তব্য রেখেছিলেন উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উলফ ডেনিয়েলসন। অনুষ্ঠানটি ইন্টারনেটে সরাসরি (লাইভ) দেখছিলেন সুরাইয়া। পরে ওই অধ্যাপকের কাছ থেকেই অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতার কথা শুনে আরও অনুপ্রাণিত হন। লিনডাউয়ের পরবর্তী সভার জন্য তৈরি হতে থাকেন। নিজের গবেষণা নিয়ে ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছাড়াও সুইডেনে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্মেলনে যোগ দেন তিনি।
সুরাইয়া বলেন, ‘২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তিনজন নোবেলজয়ী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিতে আসেন। কোর্সের কারণে সেবার যোগ দিতে পারিনি। ভেবেছিলাম, এবার পারিনি, সামনের বছর পারব। কিন্তু ২০২০ সালে কোভিড শুরু হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নোবেলজয়ীদের সরাসরি বক্তব্য দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় প্রচণ্ড আফসোস হচ্ছিল।’ ২০২২ সালে আবার সুযোগ আসে। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেলজয়ীদের উন্মুক্ত একটি বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়। সকাল নয়টায় ছিল সেই বক্তব্য। ভোর ছয়টার ট্রেন ধরে দুই ঘণ্টা যাত্রা শেষে সুরাইয়া অনুষ্ঠানে পৌঁছান।
গত বছরের অক্টোবরে লিনডাউ ঘোষণা দেয়, এবারের সভার বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। রয়েল সুইডিশ একাডেমির মাধ্যমে আবেদন করেন সুরাইয়া। বিভিন্ন সম্মেলনে উপস্থিতি ও গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনার অভিজ্ঞতাই তাঁকে লিনডাউ সভার জন্য মনোনীত হতে সাহায্য করে।
নোবেলজয়ীদের সঙ্গে
লিনডাউ সভায় নোবেলজয়ীদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন আলোচনা ও কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া ছোট ছোট দলে নোবেলজয়ীদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা বলা, সকালের নাশতা বা দুপুরের খাবার টেবিলে আলাপ-আলোচনা, এসব সুবর্ণ সুযোগও ছিল।
সুরাইয়ার ভাষায়, ‘পুরো পরিবেশ এতটা আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল যে নোবেলজয়ীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হয়নি তাঁরা বিখ্যাত কেউ। বরং তাঁদের সহকর্মী বলে মনে হয়েছে। তরুণ বিজ্ঞানীরা কী নিয়ে গবেষণা করেন, সেটা নিয়ে তাঁদের আগ্রহ আরও বেশি ছিল। আনুষ্ঠানিক আলোচনার বিরতিতে বিজ্ঞানের বাইরেও নানা গল্পে মেতেছিলেন তাঁরা।’ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মনোনীত হওয়ার পর নাসার বিজ্ঞানী জন সি ম্যাথার (২০০৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী) সুরাইয়াকে বলছিলেন, ‘সেলিব্রেটি হয়ে তোমার কেমন লাগছে?’
বক্তৃতার পর বাংলাদেশের এই তরুণ বিজ্ঞানী অবশ্য আদতেই ‘সেলিব্রেটি’ বনে গিয়েছিলেন। সুরাইয়া বলেন, ‘রাতের খাবারের সময় কাউন্সিল অব লিনডাউ নোবেল লরিয়েট মিটিংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট হাইনার লিংকে আমার পাশে বসে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। তখনো তাঁর পরিচয় জানতাম না। তিনি আমার সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। তাঁকে জানালাম, আমি বাংলাদেশি। লিনডাউ সভা নিয়ে কতটা রোমাঞ্চিত ছিলাম, তা-ও বললাম।’
সমাপনী অনুষ্ঠানের ভিডিও থেকে দেখা যায়, সুরাইয়া মূলত লিনডাউ সভার পথে তাঁর যাত্রার কথাই তুলে ধরেছেন। মুহুর্মুহু করতালিতে তাঁকে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন সবাই।
সুরাইয়া জানান, তিনি বক্তৃতা দেওয়ার সময় খুব আগ্রহ নিয়ে তাঁর কথা শুনছিলেন নোবেলজয়ী নারী পদার্থবিজ্ঞানী ডনা স্ট্রিকল্যান্ড। সব মিলিয়ে এই সভা থেকে শিখেছেন অনেক। কুড়িয়েছেন অনুপ্রেরণা। যা তাঁর মধ্যে ভবিষ্যতে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে বড় কিছু করার স্বপ্ন তৈরি করেছে।