শিশুকে যেভাবে বইয়ে আগ্রহী করে তুলবেন

শিশুর বিকাশে দারুণ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বইছবি: প্রথম আলো

শৈশবে একখানা দারুণ বই যেন আনন্দময় এক জগতের দুয়ার। সেই জগতের ছাপ পড়ে শিশুর মননে ও সৃজনশীলতায়। শিশুর বিকাশে দারুণ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বই। তবে বাস্তবতা হলো, মুঠোফোন-ইউটিউবের এই যুগে অনেক শিশুকেই বইয়ে আগ্রহী করে তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকেরা। কীভাবে বইয়ের প্রতি শিশুকে আগ্রহী করে তোলা যায়, সে প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিলাম।

আগে শোনা, পরে পড়া

জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলছে, পড়তে শেখার আগেই শিশুকে বই পড়ে শোনানো প্রয়োজন। শিশুতোষ গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপগুলো বিভিন্ন স্বরে পড়ে শোনানো যেতে পারে। চরিত্রগুলোর বিষয়ে তাকে বলুন। প্রাণীর উল্লেখ থাকলে সেগুলোর ডাক কিংবা ভঙ্গি অনুকরণ করতে পারেন মজা করে। আপনার পড়ার কারণেই শিশুর কাছে মজাদার ও আকর্ষণীয় একটা জিনিস হয়ে উঠবে বই। শিশুকে বই পড়ে তো শোনাবেনই, নিজেও পড়বেন। শিশুরা ভীষণ অনুকরণপ্রিয়। আপনাকে বই নিয়ে বসতে দেখলে সেও একই কাজ করতে চাইবে। সে যখন পড়তে শিখবে, তখন তাকেও বলুন আপনাকে বই পড়ে শোনাতে। তাকে পড়ে শোনানোর কাজটাও আপনি চালিয়ে যান। শিশু একটু বড় হওয়ার পর তাদের আগ্রহের বিষয়ের বই খুঁজে দেওয়ার প্রতিও জোর দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

শিশুকে নানা ধরনের বই দিতে চেষ্টা করুন
ছবি: প্রথম আলো

আনন্দের অবারিত উৎস

আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, বই পড়ার পর বইয়ের গল্পটা বলতে পারা একটি চমৎকার শিল্প। এমন শিল্পের চর্চা হতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। স্কুলের লাইব্রেরিতে রাখা যেতে পারে ভিন্ন স্বাদের বই। এমনকি এসব বই পড়ার ওপর কিছু নম্বরও বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। একবার বইয়ের মজা পেয়ে গেলে শিশুর নিজেরই তখন আরও পড়ার ইচ্ছা জাগবে। কত কী পড়ার আছে! রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, জসীমউদ্‌দীন, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ সাহিত্যিকের শিশুতোষ বই এ যুগের শিশুদের কাছেও সমান আগ্রহের হয়ে উঠতে পারে। তবে গুণী লেখকদের সঙ্গে পরিচয়টা তো বড়দের মাধ্যমেই হতে হবে। ছড়া, কমিক কিংবা রঙিন ছবিওয়ালা বইয়ে আগ্রহ পেতে পারে শিশু। নন্টে-ফন্টের মতো হাসির কমিক হলে তো কথাই নেই। শিশুতোষ অনুবাদও তুলে দিতে পারেন।

আধুনিকতার ‘বাধা’ পেরিয়ে

ডিজিটাল ডিভাইসের বিপরীতে বই পড়াটা কষ্টকর মনে হতে পারে শিশুর কাছে। ডিভাইসের প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে মা-বাবাকে যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জসিম উদ্দীন। শিশুর মানসিক বিকাশে বইকে আনন্দময়ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন অভিভাবক। নিজেই বই পড়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন, শিশুকে বই পড়ে শোনানো ও শিশুর সঙ্গে বসে বই পড়ার প্রতি জোর দিলেন এই চিকিৎসক।

শিশুকে বই পড়ে শোনানো প্রয়োজন
ছবি: প্রথম আলো

আর চাই পড়ার সুযোগ

শিশুর জন্য পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করুন। তার হাতের নাগালেই বই রাখুন। খেয়াল রাখুন, বইগুলো যেন তার জন্য খুব কঠিন বা একঘেয়ে হয়ে না পড়ে। তার উপযোগী বই বেছে নেওয়ার কথা বলছিলেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশুকে নানা ধরনের বই দিতে চেষ্টা করুন। বই পড়ার জন্য বাড়িতে আরামদায়ক একটা জায়গা রাখুন। রোজ কিছুটা সময় দিন তার ইচ্ছেমতো কিছু পড়ার জন্য। বাড়িতে বড়দের বই পড়ার চর্চা থাকলে পরিবেশটা ইতিবাচক হয়। ঘুমের আগেও শিশুকে নিয়ে বই পড়তে পারেন।

আলোচনা কিংবা কল্পনা

শিশু কী পড়ল, আর আপনি কী পড়লেন, মাঝেমধ্যে সেই নিয়ে আলাপ করতে পারেন। বইয়ের কোনো ঘটনার গভীরে যেতে পারেন শিশুর সরলতা নিয়েই। বইয়ের একটি চরিত্র কী ভেবে একটি কাজ করেছে, তার ফলাফল কী হয়েছে, পরিবর্তে সে কী করতে পারত, এ ধরনের মজার ‘আলোচনা’ও চলতে পারে শিশুর সঙ্গে। চরিত্রটির জায়গায় শিশু নিজে থাকলে সে কী করত, এমন কথাও জানতে চাইতে পারেন তার কাছে। বাস্তবের কোনো চরিত্রের সঙ্গেও মিলিয়ে দিতে পারেন বইয়ের চরিত্রকে।

শিশুর জন্য পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করুন
ছবি: প্রথম আলো

বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ

শিশুকে বইমেলায় ও বইয়ের দোকানে নিয়ে যান। পছন্দের বই কিনে দিন। ভালো কাজের পুরস্কারও হতে পারে বই। ধীরে ধীরে তার একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরিও গড়ে উঠতে পারে। আপনজনেরা যদি প্রায়ই শিশুকে এটা-ওটা উপহার দেন, তাহলে তাদেরও বলে রাখতে পারেন বই উপহার দিতে।

বই পড়তে আগ্রহী, এমন শিশুদের সঙ্গে মেশার সুযোগ দিন তাকে। একটু বড় হলে প্রতিবেশী শিশুর সঙ্গে বই অদলবদল করতে পারে সে। স্থানীয় লাইব্রেরি কিংবা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির সদস্যও করে দিন শিশুকে।

আরও যা মনে রাখবেন

  • শিশুকে নিয়ে কোথাও অপেক্ষা করতে হবে, মনে হলে তার সময় কাটানোর জন্য কিছু বই সঙ্গে নিয়ে নিন।

  • শিশু বই পড়লে তার প্রশংসা করুন। তাকে উৎসাহ দিন। একই বই বারবার পড়তে চাইলেও ক্ষতি নেই।

  • বইয়ের কোনো সিরিজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন তাকে। তাহলে সে একটি বইয়ের পর অন্যটি পড়ার আগ্রহ পাবে।

আরও পড়ুন