লেবাননে নয়, তুষার পাড়ি জমাল অনন্তলোকে
জুবায়ের কবির তুষারকে মাত্র একটি বিশেষণে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে ‘খাঁটি দেশপ্রেমিক’ শব্দযুগলই জুতসই। প্রথম আলো বন্ধুসভার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন তুষার। গড়ে তুলেছিলেন ‘হিমু পরিবহন’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ২০১৬ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসে। গতকাল ২ সেপ্টেম্বর তিনি অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে। বন্ধুদের পক্ষ থেকে এই লেখার মাধ্যমে তুষারের জন্য ভালোবাসা...
দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ২০০৯ সালের কথা। প্রথম আলোর ঠিকানা তখন সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। সিএ ভবনের লিফটে ওঠার সারিতে দাঁড়িয়ে আছি। লিফট নেমে এল। দরজা খুলল। নজর কাড়ল একটা হাসিমুখ। ছেলেটার বাঁ গালে টোল। দেখে মনে হলো, সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। অচেনা ছেলেটার হাসিমুখের উত্তরে ভদ্রতার খাতিরে হাসলাম। আর সে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি জুবায়ের কবির তুষার, বন্ধুসভার হয়ে গাছ লাগাতে যাচ্ছি, ভাই। দোয়া রাখবেন।’
সেই যে তুষারের হাসিমুখটা দেখলাম, তার পর থেকে খেয়াল করলাম, এই ছেলের মুখে হাসি লেগে থাকে নিশিদিন। শুধু হাসিই নয়, ওর সঙ্গে ‘উদ্যম’ শব্দটাও সেঁটে থাকে সারাক্ষণ। ধীরে ধীরে পরিচয়, খাতির, ঘোরাঘুরি, আড্ডার ফাঁকে বুঝে ফেললাম, এই ছেলে সাংঘাতিক! কারও রক্ত লাগবে, তুষারকে ফোন করো। ঝড়ে আর্ত মানুষের দোরে ত্রাণ পৌঁছাতে হবে, কে কে যাবে? তুষার যাবে। দেশের উত্তরাঞ্চলে শীতার্তদের গরম কাপড় দিতে হবে? তুষার আছে না! ও যাবে। কারও মন খারাপ? তুষার বলবে, ‘চলো, ঘুরে আসি।’
এই করে করে প্রথম আলো বন্ধুসভার সবচেয়ে আন্তরিক বন্ধুদের অন্যতম হয়ে উঠল তুষার। বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থান—সব ওর কাছে তুচ্ছ। সবাইকে বন্ধু বানিয়ে ফেলার এক আশ্চর্য গুণ ওর সহজাত।
এক সন্ধ্যায় তুষার বলল, ‘ভাই, কোথায় যান?’ বললাম, ‘কাঁটাবন।’
‘একা যাবেন?’
‘হ্যাঁ, একাই তো।’
‘চলেন, আমিও যাব।’
কাঁঠালবাগান ঢাল থেকে রিকশা নিলাম। তুষার বলল, ‘আপনার সঙ্গে আসলাম বলে বিরক্ত হন নাই তো?’
তুষারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আরে, ধুর! বিরক্ত হব কেন?’
‘আপনার সঙ্গে কেন আসলাম, জানেন?’
‘কেন?’
‘মানুষের সঙ্গে মিশতে আমার ভালো লাগে, ভাই। আশপাশে মানুষ না থাকলে কেমন যেন খালি খালি লাগে।’
ওটা যে তুষারের মুখের কথা ছিল না, তা খেয়াল করেছি সব সময়। তুষার মানুষের সঙ্গে ছিল আজীবন। তুষার থাকবে আর ওকে ঘিরে একটা জটলা থাকবে না, তা হওয়ার নয়। আর এই গুণে ও বন্ধুসভার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী থেকে হয়ে উঠেছিল দারুণ সংগঠক। দলবল নিয়ে ও ছুটে যেত মানুষের উপকারে। ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বন্ধুসভার হয়ে ও যায়নি, এমন জেলা সম্ভবত নেই। ফলে দেশের আনাচকানাচে ওর বন্ধু আর দিকে দিকে সুনাম।
‘বাংলাদেশ জিতবে’
আরেকটা সুনাম ছিল তুষারের—অসম্ভব আশাবাদী। বাংলাদেশ ক্রিকেট ওর ‘জানের টুকরা’–জাতীয় কিছু একটা ছিল। বাংলাদেশের হয়তো ৮টা উইকেট পড়ে গেছে, হাতে আছে ১০টা বল, রান লাগবে ৬০। তারপরও তুষার আশাবাদী, ‘বাংলাদেশ জিতবে!’
আমরা ওর অতি বাড়াবাড়ি আশাবাদ নিয়ে ঠাট্টা করতাম। ক্রিকেট বাদেও অন্য কোনো ক্ষেত্রে কাউকে অসম্ভব আশাবাদী হতে দেখলেই টিপ্পনী কেটে বলতাম, ‘তুমিও দেখি তুষার হয়ে যাচ্ছ!’
অবশ্য আক্ষরিক অর্থে অনেকেই তুষার হয়ে উঠেছিল। ক্রিকেটের মতো হুমায়ূন আহমেদও ছিলেন তুষারের অতি আপন। অন্ধভক্ত যাকে বলে। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে নুহাশপল্লীতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিল তুষার ও তার বন্ধুরা। ছেলেদের কেউ কেউ হলুদ পাঞ্জাবিতে হয়ে উঠেছিল হিমু, মেয়েদের কেউ কেউ নীল শাড়িতে রূপা। ২০১৩ সালের সেদিন বাসে চেপে যেতে যেতেই তুষাররা ঠিক করেছিল, ‘হিমু পরিবহন’ নামে একটা সংগঠন করবে ওরা। তুষার কিছু বলবে আর তা বাস্তব রূপ পাবে না, তা হওয়ার নয়। ঠিকই হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে চালু হলো হিমু পরিবহন।
আর তখন থেকেই তুষার ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওরা একটা ক্যানসার হাসপাতাল বানাবে। প্রিয় লেখক ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন বলেই তুষার একেবারে মরিয়া, যে করেই হোক ক্যানসার হাসপাতাল করতেই হবে। পাগলের মতো নানা প্রতিষ্ঠান, গুণীজনের কাছে ছুটে গেল ও। সবার সহযোগিতা চায়। প্রায় সবাই পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে শুধু প্রতিশ্রুতি পেলেই যে হয় না, তাই তুষার উদ্যোগটার পেছনে লেগে থাকল রাতদিন ২৪ ঘণ্টা! হ্যাঁ, রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই। কারণ, তখন ও ক্যানসার হাসপাতাল ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। কাছের মানুষেরা শঙ্কিত, ‘ছেলেটা তো পাগল হয়ে যাবে!’
‘হয়ে যাবে, ভাই’
অনেকেই ওকে বোঝাতে লাগল, ‘দেখো, ক্যানসার হাসপাতাল অনেক বড় একটা ব্যাপার, একটু দম নাও।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। তুষার যে ছোট স্বপ্ন দেখার মানুষ না। তাই ওর ‘পাগলামি’ চলতেই লাগল। শেষমেশ না পেরে একদিন ওকে বাসায় নিয়ে বোঝালাম, ও সব শুনে শুধু হাসে আর বলে, ‘জি, ভাই। জি, ভাই।’ কথা যখন শেষ, তখন বলে, ‘কিন্তু ভাই, আমরা ক্যানসার হাসপাতাল করবই! হয়ে যাবে, ভাই!’
এই ‘হয়ে যাবে’ কথাটাও ছিল তুষারের চিরসঙ্গী। ওর কাছে যেন কিছুই অসম্ভব ছিল না। কিছু একটা বললেই বলত, ‘হয়ে যাবে, ভাই!’
লেগে থাকার এই গুণ তুষারের মজ্জাগতই ছিল। আমরা বন্ধুবান্ধবেরা ‘ঝাঁকের কই’ নামে পরিচিত। একবার আমরা ঝাঁকের কইয়েরা গেলাম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাতই হয়ে গেল। সঙ্গে মুরগি, মসলা, তেল, লবণ নিয়েছি। বারবিকিউ হবে। কিন্তু আগুন তো আর জ্বলে না! কাঠ একেবারে ভেজা। এদিকে পেটের তর সইছে না। আগুন জ্বালানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল তুষার। বিএনসিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) করা তুষার এসবে সিদ্ধহস্ত। আমরা এদিক–ওদিক ঘুরি আর বারবার উঁকি মারি, আগুন কি জ্বলল? তুষার ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে ঠিকই একসময় আগুন জ্বালিয়ে ফেলল।
ওর একই রকম উদ্যম দেখেছি বন্ধুসভার বার্ষিক আয়োজন বন্ধু উৎসবে। দেশের হাজার হাজার বন্ধুর সমাবেশ হতো মৌচাকের জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাঠে। আয়োজনের সব কাজে তুষার সদা তৎপর। গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগ, ইন্টারনেট উৎসব, বিতর্ক উৎসব, জিপিএ–৫ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানসহ প্রথম আলোর যেকোনো উদ্যোগে ওকে আমরা পাশে পেয়েছি সব সময়। সাভারের রানা প্লাজা ধসে আহত ব্যক্তিদের সেবায়ও নিবেদিত ছিল তুষার। হিমু পরিবহন যে কেবল ক্যানসার হাসপাতালের স্বপ্ন দেখেছিল, তা নয়; তুষারের নেতৃত্বে একাধিক মেডিকেল ক্যাম্প হয়েছে। ত্রাণ সংগ্রহ করে তুলে দিয়েছে বন্যার্তদের হাতে। এমন আরও কত যে নিঃস্বার্থ উদ্যোগের সঙ্গে তুষারের নাম জড়িয়ে আছে, তা বলে শেষ করা কঠিন! এর চেয়ে ঢের ঢের কঠিন তুষারের অকালপ্রয়াণ মেনে নেওয়া।
তুষারের ‘প্রিয় বাংলাদেশ’
২০১৬ সালে তুষার চলে গেল লেবানন। ছয় মাসের জন্যই গিয়েছিল সেবার। ওর চাকরিটা হয়েছিল লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসে। তবে বরাবরই যা হয়েছে, তুষার যেখানেই গেছে, মায়ার বাঁধনে জড়িয়েছে সবাইকে। ফলে অবধারিতভাবে দূতাবাস ওকে ছাড়ল না। চাকরির মেয়াদ বাড়ল। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ও দায়িত্ব পালন করেছে লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসে কনস্যুলার অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছেও পরম আপনজন হয়ে উঠেছিল তুষার। রাতদিন সবার পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে নানা আয়োজনের মধ্যমণিও ছিল।
লেবাননে থাকলেও তুষারের মনটা যে পড়ে থাকত বাংলাদেশেই, তা দিব্যি টের পাওয়া যেত ফেসবুকে ওর উপস্থিতি দেখলে। বাংলাদেশে কারও কোনো সাহায্য দরকার, তুষার আওয়াজ দিচ্ছে। পরিচিতদের পাঠিয়ে দিচ্ছে সহযোগিতা করতে। এমনকি গাঁটের পয়সা খরচ করতেও বিন্দুমাত্র ভাবেনি। কখনো কখনো এমনও হয়েছে, বাংলাদেশে থেকেও আমরা যে খবর পাইনি, তুষার তা জেনে বসে আছে!
অথচ আমরা জানতেও পারিনি তুষারের কী অসুখ! সবার খোঁজখবর ঠিকঠাক রাখলেও নিজের ডায়াবেটিস যে এতটা মাথাচাড়া দিয়েছে, তা জানায়নি কাউকে! ও লেবানন থেকে ছুটিতে দেশে এসেছিল সপ্তাহ দুয়েক আগে। এসেই নানাভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল বন্যার্তদের সহযোগিতায়। এর মধ্যে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করেছে, আড্ডা দিয়েছে হাসিমুখে।
গতকাল ২ সেপ্টেম্বর লেবাননে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল ওর। অথচ পাড়ি জমাল অনন্তলোকে! তুষার সারাক্ষণ ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ’ করত। ওর সব চিন্তা–কাজে দেশ আর দেশের মানুষ ছিল আগে। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ওর মৃত্যু হলো প্রিয় বাংলাদেশেই। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, এটাই হয়তো আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, তুষার চলে গেছে, এর মধ্যে আবার সান্ত্বনা হয় নাকি!