অলিম্পিক ভিলেজের স্থাপনাগুলো পরে কী করা হয়

অলিম্পিকের প্রথম সাতটি আসরে আয়োজক শহরের বিভিন্ন হোটেল, স্কুল আর ব্যারাকে ছিল অ্যাথলেটদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। নৌকায় থাকার নজিরও আছে। ফলে থাকা-খাওয়ার সমান সুযোগ পেতেন না সব অ্যাথলেট। তাই ১৯২৪ সালে অলিম্পিকের অষ্টম আসরে অ্যাথলেটদের জন্য তৈরি করা হয় ‘অলিম্পিক ভিলেজ’। যেখানে সবার থাকা-খাওয়ার জন্যই ছিল সমান সুযোগ-সুবিধা। সেই অলিম্পিক আসরেরও আয়োজক ছিল ফ্রান্স। ‘অলিম্পিক ভিলেজ’ নিয়ে মজার পাঁচ তথ্য জানাচ্ছেন মৃণাল সাহা

১৯২৪ সালে অলিম্পিকের অষ্টম আসরে অ্যাথলেটদের জন্য তৈরি করা হয় ‘অলিম্পিক ভিলেজ’
ছবি: সংগৃহীত

১. ব্যয়সাশ্রয়ী সমাধান

১৯২৪ সালে অলিম্পিকের জন্য নতুন নিয়ম তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)। বলা হয়, স্বাগতিক শহরকে প্রত্যেক অ্যাথলেটের জন্য থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তখনই ফরাসিদের মাথায় নতুন একটা বুদ্ধি খেলে যায়। অংশগ্রহণকারী সব অ্যাথলেটকে যদি এক ছাদের নিচে নিয়ে আসা যায়, তাহলে কেমন হবে? অলিম্পিকের মূলমন্ত্র সম্প্রীতির বন্ধনে সবাইকে এক করা হলেও অনুঘটক হিসেবে কাজ করল অর্থ। প্যারিসের মতো ব্যয়বহুল শহরে সব অ্যাথলেটদের হোটেলে রাখার মতো টাকাকড়ি আয়োজকদের ছিল না। বরং অস্থায়ী বাসা তৈরি করে সেখানে অ্যাথলেটদের রাখা আয়োজকদের জন্য ছিল অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী। অলিম্পিকের প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো অলিম্পিক ভিলেজের কাজও। অলিম্পিকের মূল মঞ্চ ‘অলিম্পিকা ডি কলম্বোস’-এর পাশেই তৈরি করা হলো ‘অলিম্পিক ভিলেজ’। ৩ হাজার অ্যাথলেটের জন্য সেখানে ছিল কাঠের ঘর, সেলুন, ডাকঘর, রেস্তোরাঁসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা। অলিম্পিক শেষ হওয়ার পরপরই ভেঙে ফেলা হয়েছিল ঘরগুলো।

আরও পড়ুন
প্যারিসের অদূরে সেন্ট-ডেনিসে গড়ে উঠেছে এবারের ‘অলিম্পিক ভিলেজ’
ছবি: সংগৃহীত

২. শহরের কথা ভেবে ‘গ্রাম’

শুধু অলিম্পিয়ানদের জন্য নয়, পুরো শহরের কথা বিবেচনায় নিয়েই এখন বানানো হয় অলিম্পিক ভিলেজ। জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি, আবাসন, ইত্যাদি মাথায় রেখে প্রতিটি ভিলেজকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যেন এটা পুরো শহরের অংশ হয়ে ওঠে। পুরো অলিম্পিক ভিলেজকে এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে অলিম্পিকের পর জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া যায়। প্যারিসের অদূরে সেন্ট-ডেনিসে যেমন গড়ে উঠেছে এবারের ‘অলিম্পিক ভিলেজ’। শহরটির উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই সাজানো হয়েছে এই ‘গ্রাম’। প্যারিস ২০২৪ অলিম্পিকের টেকসই পরিকল্পনার পরিচালক জর্জিনা গ্রেনন বলেন, ‘আমরা এটাকে একটা নতুন আবাসন প্রকল্প হিসেবে দেখছি। বিষয়টি এমন যেন কয়েক মাসের জন্য এই ভিলেজ ভাড়া নিচ্ছে প্যারিস অলিম্পিক।’ অলিম্পিক শেষে সব কটি ভবনই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হবে। অর্ধেক আবাসনের জন্য, বাকি অর্ধেক অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হবে। সংশ্লিষ্ট অনেকের আশা, প্যারিসের বাসা ভাড়ার ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টেনে ধরবে এই অলিম্পিক ভিলেজ।

৩. মুভি স্টুডিও হয়েছে রেস্তোরাঁ

এবারের অলিম্পিক ভিলেজে আছে ৮২টি ভবন। অলিম্পিকজুড়ে যেখানে প্রায় ২০ হাজার খেলোয়াড় আর কলাকুশলীর আনাগোনা থাকবে। থাকার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট, রেস্তোরাঁ, প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে শুরু করে সবকিছুই রয়েছে। প্যারিসের ভেতর যেন নতুন এক শহর গড়ে তুলেছে আয়োজকেরা। তাদের মতে এই সবকিছুই করা হয়েছে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে, যতটা সম্ভব সাশ্রয়ী করে। খরচ কমাতে নির্মাণাধীন কয়েকটি ভবনকেও অলিম্পিক ভিলেজের অংশ করে নেওয়া হয়েছে। পরিত্যক্ত একটা চলচ্চিত্র স্টুডিওকে বানানো হয়েছে বিশাল একগুচ্ছ রেস্তোরাঁ। যেখানে অ্যাথলেটদের জন্য রয়েছে ছয়টি আলাদা আলাদা রেস্তোরাঁ। তাদের বিশাল বিশাল ডাইনিং হল। প্রতিদিন সেখানে প্রায় ২০ হাজার লোকের খাবারের ব্যবস্থা আছে।

এবারের অলিম্পিক ভিলেজে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে কুলিং সিস্টেম
ছবি: রয়টার্স

৪. এসি ছাড়াই ঠান্ডা এই গ্রাম

এবারের অলিম্পিক ভিলেজে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে কুলিং সিস্টেম। নির্দিষ্ট কয়েকটি দালান বাদে (ভবিষ্যতে যেগুলো অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হবে) এই গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকেও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়াই অলিম্পিক ভিলেজকে ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করেছেন আয়োজকেরা। প্রায় প্রতিটি বিল্ডিংয়েই ছাদেই সবুজের সমারোহ। সোলার প্যানেল দিয়েই তৈরি করা হয়েছে কিছু বিল্ডিংয়ের ছাদ। সিন নদী থেকে ঠান্ডা বাতাস সরাসরি যাতে অলিম্পিক ভিলেজে প্রবেশ করতে পারে, তার জন্য রাখা হয়েছে রাস্তা। অলিম্পিক ভিলেজের কয়েকটি ফুটপাত সামুদ্রিক শেল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বৃষ্টির দিনে যেমন দ্রুত পানি শোষণ করে নেবে, তেমনই ধরে রাখা পানি গরমের দিনে পথচারীদের ঠান্ডা রাখবে। আর প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের নিচেই রয়েছে ওয়াটার কুলিং সিস্টেম, যা প্রতিটি ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ৬ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে রাখবে। অলিম্পিক ভিলেজের কুলিং সিস্টেম নিয়ে বেশ কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে অলিম্পিক কমিটির কাছে। বিশেষ করে ওপরতলার ঘরগুলোয় কুলিং সিস্টেম কাজ করে না, এমন অভিযোগ করেছেন কিছু অ্যাথলেট। এই গরম ছাড়াও নানা সুযোগ-সুবিধার অভাবে ও ব্যক্তিগত কারণে অলিম্পিক ভিলেজ ছেড়ে হোটেলে উঠেছেন অনেক অ্যাথলেট।

টোকিও অলিম্পিকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘এন্টি-সেক্স বেড’ এবারের অলিম্পিকেও আছে
ছবি: রয়টার্স

৫. এবারও আছে ‘এন্টি-সেক্স বেড’

টোকিও অলিম্পিকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘এন্টি-সেক্স বেড’ এবারের অলিম্পিকেও আছে। কার্ডবোর্ডে তৈরি এই বিছানা তুলনামূলকভাবে হালকা, অতটা মজবুতও নয়। করোনাকালে সংক্রমণ ঠেকাতে অ্যাথলেটদের যৌনকর্ম থেকে নিরুৎসাহিত করতেই এই বিছানা বানানো হয়েছিল। তবে এবারও থাকছে এই বিছানা। খেলা থেকে অ্যাথলেটদের মনোযোগ যাতে অন্যদিকে না যায়, সে ক্ষেত্রে নাকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই বিছানা। সুলভ মূল্য ও পরিবেশগত কারণে অ্যাথলেটদের এমন বিছানা দেওয়া হয়েছে, জানিয়েছেন আয়োজকেরা। তবে বিছানা যেমনই হোক, যত দামেরই হোক না কেন, আরামের বিষয়ে কোনো কমতি রাখেনি আয়োজকেরা। বিছানার মান এবং আরাম নিয়ে অ্যাথলেটদের কাছ থেকে গতবারের তুলনায় তেমন অভিযোগ আসেনি। অলিম্পিয়ানদের থাকার জন্য মোট ১৪ হাজার ২৫০টি বিছানা তৈরি করেছেন আয়োজকেরা। প্রতিটি ঘরে দুটি করে বিছানা। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে ৩ থেকে ৪টি করে ঘর। দেশ অনুযায়ী একই অ্যাপার্টমেন্ট ৫ থেকে ১০ জন অ্যাথলেটের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু বিছানা নয়, ঘরের আসবাবপত্রও পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী দিয়ে বানানো হয়েছে। কার্ডবোর্ড সিয়ে টুল, পুনর্ব্যবহৃত উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ম্যাট্রেস।

তথ্যসূত্র: সিএনএন