ফ্যাক্টচেকিংয়ের অভ্যাস কেন জরুরি, কীভাবে এই চর্চা করব
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়ে আমরা দেখেছি, তথ্যপ্রযুক্তিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করেছে জেন-জি। এই তথ্যপ্রযুক্তি কিন্তু তথ্যের অতিপ্রবাহও নিয়ে এসেছে। আমাদের চারপাশে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন প্রচুর তথ্য। এত সব তথ্যের মধ্যে সঠিক তথ্যটি বাছাই করা আমাদের সময়ের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।
কেন জরুরি
বেশির ভাগ সময় সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিডে আমরা এমন তথ্য পাই, যা আমরা দেখতে ও শুনতে পছন্দ করি। এটাই হচ্ছে ‘ইকো চেম্বার’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদমের কারণে আমরা অনেকেই নিজেদের ইকো চেম্বারের বাইরে যাই না। এর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, তখন আমরা ভিন্নমত বা চিন্তার প্রতি সহনশীলতা হারিয়ে ফেলি। গঠনমূলকভাবে সেটিকে মোকাবিলা করতে পারি না। ফ্যাক্টচেকিং (তথ্য যাচাই) আমাদের এই ইকো চেম্বারের বাইরে গিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে। নির্দিষ্ট তথ্য কিংবা মতামতের পাশাপাশি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি জানতেও সহায়তা করে।
ফ্যাক্টচেকিংয়ের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে তথ্যের উৎস যাচাই, প্রমাণ খুঁজে বের করা, একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করা, সর্বোপরি একটি ‘ইনফরমড জাজমেন্ট (তথ্য যাচাই–বাছাই করে সিদ্ধান্ত)’ নেওয়া। যেহেতু আমাদের নতুন প্রজন্ম সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, তাই জনপরিসরে তাঁদের অবস্থান যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেটা ভাবনায় রাখতে হবে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা কতটা জরুরি, সেটি আমাদের তরুণসমাজের চেয়ে ভালো কে জানে!
নিঃসন্দেহে নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিগত যেকোনো প্রজন্মের চেয়ে অনেক দক্ষ। অনেক অল্প বয়স থেকেই তাঁরা ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত। অন্য যেকোনো প্রজন্মের চেয়ে অপতথ্য মোকাবিলা করার দক্ষতাও তাঁদের বেশি। কিন্তু তাঁদের দক্ষতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপতথ্যের উৎপাদনও বাড়ছে। অপতথ্য যারা তৈরি করে, তারা মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝেই সেটা করে। ফলে অপতথ্য বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ২০২১ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই ‘ফ্যাক্ট’ আর ‘ফিকশন’ আলাদা করতে পারে না। তাঁরা অনলাইনে পাওয়া তথ্য সহজেই বিশ্বাস করে ফেলেন। বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে এমন গবেষণা না থাকলেও আমাদের অবস্থা এর থেকে খুব ভিন্ন হওয়ার সুযোগ খুবই কম। দেশের যেকোনো একটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট ঘাঁটলেই এর প্রমাণ মিলবে।
তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস
তরুণদের এই সমস্যার সমাধান হতে পারে ‘লেটারাল রিডিং’, অর্থাৎ অনলাইন ব্রাউজের সময় অনেকগুলো ট্যাব খুলে তথ্য যাচাই–বাছাই করার অভ্যাস। অনলাইনে কিছু পেলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ট্যাব খুলে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান, একাধিক নির্ভরযোগ্য সোর্সের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া। ফ্যাক্টচেকিংয়ের বিভিন্ন টুলস সম্পর্কে ধারণা থাকলে কাজটি সহজ হয়ে ওঠে। যদি কোনো ছবি বা ভিডিও সামনে আসে, সেটি কীভাবে যাচাই করতে হয়, এসব বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি।
যেকোনো সংকটকালে গুজবের প্রাদুর্ভাব স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি হয়। যেমন সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানেও আমরা অনেক গুজব লক্ষ করেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে, সংসদ ভবনে গণকবর পাওয়ার দাবি। আমাদের অনেকেই তখন তথ্যটি শেয়ার করেছি। শেয়ার করার আগে কিছুটা অনুসন্ধান করলেই জানা যেত যে ঘটনাটি সঠিক নয়। সংসদ ভবনে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সে সময় আন্দোলনে যাওয়া এমন অনেক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবরও আমরা শেয়ার করেছি, যাঁরা আদতে মারা যাননি।
গুগল লেন্সের ব্যবহার
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যার দাবিতে ছড়িয়ে পড়া নিচের ছবিটি লক্ষ করুন। শেয়ার করার আগে আমরা যদি গুগল লেন্সের মাধ্যমে সহজ একটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করতাম তাহলেই দেখতে পেতাম যে ছবিটি বাংলাদেশের নয়, ভারতের। শেয়ার করার আগে দুটি ক্লিক করার মাধ্যমেই সত্যতা বের করা যায়। প্রথমে ছবির ওপরে ‘রাইট ক্লিক’, এরপর ‘সার্চ ইমেজ উইথ গুগল লেন্স’, ব্যস!
গুগল ম্যাপের ব্যবহার
আরেকটি দক্ষতা হচ্ছে কোনো স্থানের বা ঘটনার ভৌগোলিক অবস্থান বের করা। গুগল ম্যাপ ব্যবহার করেই কাজটি করা যায়। যেমন নিচের এই ছবিকে ভারতের টিপাইমুখী বাঁধ দাবি করা হলেও গুগল আর্থের সহায়তায় আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে এটি মূলত শ্রীলঙ্কার একটি বাঁধ। এর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই।
অসামঞ্জস্যের খোঁজ
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া আরেকটি ছবি খেয়াল করুন। ক্রিকেটার তৌহিদ হৃদয়ের মতো আরও অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি শেয়ার করেছেন।
সাম্প্রতিক বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে মর্মান্তিক একটি ছবি। আপনার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করবে। বন্যায় যেহেতু মানবিক বিপর্যয় ঘটছে, ফলে এ রকম একটি ছবি পেলে আমরা চটজলদি শেয়ার করে দেব, এটাই স্বাভাবিক। এই প্রবণতাটাকেই বলে ‘কনফারমেশন বায়াস’। এখন আপনি যদি একমুহূর্ত থামেন, তবে অনেক কিছুই আপনার ভাবনায় আসতে পারে। প্রথমে হয়তো ভাববেন, ছবিটা অন্য কোনো জায়গার কিংবা অন্য কোনো সময়ের কি না। কিন্তু রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধান করে সে রকম কিছু পাওয়া গেল না। অর্থাৎ এটি ইন্টারনেটে আগে থেকে ছিল না। নতুন ছবি। এমন অবস্থায় ছবিটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাক। একটি বাচ্চা পানিতে বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে আতঙ্ক। ছবিটা খুব ফটোগ্রাফিক, অর্থাৎ পেশাদার আলোকচিত্রীর তোলা বলে মনে হবে। সে রকম হলে সেই আলোকচিত্রী কিংবা তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম থাকার কথা। কিন্তু সেটা নেই। কেন নেই? কেন এ রকম একটা দুর্দান্ত ছবি কোনো স্বত্ব ছাড়াই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন? এখন আরেকটু ভালো করে ছবিটা লক্ষ করলে দেখা যাবে, পুরো বিষয়টি খুব একটা স্বাভাবিক নয়। প্রথমত, বন্যার স্রোতের মধ্যে একা একটি শিশুর এভাবে থাকা বিশ্বাস করাটা কঠিন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শিশুটির মুখের ভঙ্গি ও কপালের ভাঁজ। কেউ যখন চোখ বড় করে তাকায়, তখন স্বাভাবিকভাবে তার কপালে ভাঁজ দেখা যায়। কিন্তু এখানে তার কপালের ভাঁজ সেভাবে পড়তে দেখা যাচ্ছে না। এতক্ষণে আপনার হয়তো মাথায় আসতেও পারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করা ছবি নয়তো? ইন্টারনেটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনাক্ত করার বেশ কিছু টুল পাওয়া যায়। সেগুলোর দু-একটা দিয়ে যদি আপনি এই ছবি যাচাই করেন, টুলগুলো এই ছবি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি কি না, তা সম্ভাব্যতার আকারে জানাবে। এই ছবির ক্ষেত্রে আমরাও সেটা করে দেখেছি। সব কটি টুলই সাজেস্ট করেছে যে ছবিটি এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি। বাস্তবের কোনো ছবি নয়। কিন্তু এসব টুল ভুল বার্তাও দিতে পারে। সে জন্য আপনি প্রথমে খালি চোখে দেখে যেসব অসামঞ্জস্য বের করলেন, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিদিনের ইন্টারনেট ব্রাউজিং কিংবা নানা সূত্রে তথ্য পাওয়ার প্রক্রিয়াকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ‘লেটারাল রিডিং’–এর বিকল্প নেই। ফ্যাক্টচেকিং করতে হলে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী দক্ষতা ও পর্যবেক্ষণ দরকার। এটি জটিল কিছু নয়, এ জন্য তেমন কোনো কারিগরি দক্ষতাও লাগে না । শুধু প্রতিদিনের চর্চার মধ্যে থাকলেই হয়। অপতথ্য প্রতিদিন আমাদের দরজায় হানা দিচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই আমাদের ফ্যাক্টচেকিং দরকার। আগামী দিনের তথ্যসন্ত্রাস থেকে বাঁচতে হলে ফ্যাক্টচেকিংকে আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও ফ্যাক্টচেকার, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ