হলিউডের সিনেমায় গ্রাফিকসের কাজ করেন কুমিল্লার কামরুল
মার্ভেল স্টুডিওসের ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ’ নাকি ডিসির ‘ব্যাট ম্যান’ বা ‘ব্ল্যাক অ্যাডাম’—কোন চলচ্চিত্রটি আপনার প্রিয়? জেমস ক্যামেরনের অস্কারজয়ী সিনেমা অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার তো দেখেছেন? জেনে হয়তো অবাক হবেন, সিনেমাগুলোর ট্রেলারে মোশন গ্রাফিকসের কাজ করেছেন কুমিল্লার ছেলে কামরুল হাসান। মোশন গ্রাফিকস কি, জানেন তো? একধরনের অ্যানিমেশন, যার মূল উপাদান টেক্সট। কাজটা কামরুল এতই ভালো জানেন যে মার্কিন নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গের কাছ থেকে উপহার হিসেবে চকলেট যেমন পেয়েছেন, তেমনি গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ক্লিও এন্টারটেইনমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে নিজ প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড কার্ড ক্রিয়েটিভ গ্রুপের হয়ে জিতেছেন চারটি পুরস্কার।
সিনেমার প্রতি আগে থেকেই ঝোঁক ছিল তাঁর। ছোট্ট একটা নকিয়া মোবাইল সেট দিয়ে ভিডিও গ্রহণ আর টুকটাক সম্পাদনার কাজ শুরু করেছিলেন। পরে রীতিমতো আটঘাট বেঁধে সিনেমাটোগ্রাফি, গ্রাফিকস, সম্পাদনার কাজ শেখা শুরু করেন তিনি।
২০০৬ সালের আগপর্যন্ত নিজের কম্পিউটার ছিল না। বন্ধুদের বাসায় আড্ডা দিতে গেলে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত, কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন কামরুল। কোথায় ভালো কনফিগারেশনের কম্পিউটার আছে খোঁজ পেলেই হাজির হয়ে যেতেন। অবশেষে ২০১৩ সালে একটা ম্যাকবুক কেনার সুযোগ হয়। কামরুল অবশ্য এর আগেই নিজ চেষ্টায় ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, ভিএফএক্সের কাজ মোটামুটি শিখে ফেলেছেন। ২০০৯ সাল থেকে এ–সংক্রান্ত কাজ করে আয়ও করতে শুরু করেছিলেন তিনি।
কামরুল বলছিলেন, ‘আমি কোনো দিন কারও কাছ থেকে শেখার সুযোগ পাইনি। আমার কোনো টিচার নেই। আমি মূলত তিনভাবে শিখেছি। যার একটি হলো হেল্পমেনু।’ সেটা কী জিনিস?
কামরুল বুঝিয়ে বলেন, ‘প্রতিটি সফটওয়্যারে হেল্পমেন্যু নামে একটা অপশন থাকে। সেখানে বিস্তারিতভাবে সব লেখা থাকে। কোনটা দিয়ে কী করতে হয়, কোন টুল কীভাবে কাজ করে ইত্যাদি। শুরুতে এই হেল্পমেন্যুই ছিল ভরসা। এরপর অবশ্য আরও দুটি উপায় পেয়ে যাই। একটা হলো গুগল, অন্যটা ইউটিউব টিউটোরিয়াল।’ এভাবে নিজের চেষ্টায় গ্রাফিকস ডিজাইনার হয়ে ওঠেন কামরুল।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। শুরুতে নিউইয়র্কে থাকতেন। কাজ করতেন একটা প্রিন্টিং শপের ডিজাইনার হিসেবে। পরের বছর সিনেমায় কাজ করার ইচ্ছে থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে যান। গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে যুক্ত হন স্টাপলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। অস্কারজয়ী লা লা ল্যান্ড সিনেমার অন্যতম গায়ক এডি ওয়েকসের সঙ্গেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি।
কিন্তু সিনেমায় কাজ করার ইচ্ছেটা যে অপূর্ণই থেকে যাচ্ছিল! গত ১৩ এপ্রিল মুঠোফোনের আলাপে কামরুল বলছিলেন, ‘করোনায় যখন সবাই ঘরবন্দী হয়ে পড়ল, তখন আমার মাথায় এই চিন্তা ভর করল। ভালো চাকরি করছি, গ্রাফিকসের কাজও করছি, ঠিক আছে। কিন্তু সিনেমার কাজ তো আমার করা হচ্ছে না। ওটাই তো আমার মূল আগ্রহ।’
কামরুল বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রাফিকসের কাজই তাঁর শক্তি। কিন্তু হলিউডে যে মানের গ্রাফিকস হয়, সেই মানের কাজ করতে হলে আরও প্রস্তুতি প্রয়োজন। কামরুল তাই নতুন করে শেখা শুরু করেন। ভরসা এবারও সেই ভিডিও টিউটোরিয়াল। লকডাউন শেষে কর্মস্থল থেকে যখন ডাক এল, কামরুল সাড়া দেননি। দেবেনই-বা কী করে? তাঁর মাথায় তখন শুধুই হলিউডে কাজের চিন্তা!
প্রায় এক বছর ধরে বানানো পোর্টফোলিও প্রকাশ করলেন লিংকডইনে। সেটিই নজরে আসে লস অ্যাঞ্জেলেসের বিখ্যাত ট্রেলার স্টুডিও ওয়াইল্ড কার্ড ক্রিয়েটিভ গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তার। তাদের স্টুডিওতে কামরুলকে তিনি মোশন গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ২০২১ সালের নভেম্বরে কামরুল এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।
ওয়াইল্ড কার্ডে সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করেন এই তরুণ। তবে ব্যস্ততা বেশি থাকলে ছুটির দিনেও নিস্তার নেই। কামরুল জানান, প্রতিদিন গড়ে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। এভাবে গত বছর প্রায় ৪৮টি ট্রেলারের কাজ তিনি করেছেন।
সিনেমা কামরুলের কাছে বড় আবেগের জায়গা। একটা চলচ্চিত্র বানানোর স্বপ্ন এখনো তাঁর মাথায় ঘুরপাক খায়। ইচ্ছে আছে, প্রথম সিনেমার কাজ বাংলাদেশেই করবেন।