গুগল কেন আড়াই কোটি ডলারের অনুদান দিচ্ছে
কদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির অতিথি হয়েছিলেন গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই। সেখানে তিনি বক্তৃতার পাশপাশি দিয়েছেন নানা প্রশ্নের উত্তরও। তাঁর কথামালার নির্বাচিত অংশই থাকল আজ।
ভারত থেকে যখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসি, পিটসবার্গ ছিল আমার প্রথম ঠিকানা। চাচা-চাচি এখানেই থাকেন। আমার চাচা কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটিতে (সিএমইউ) কাজ করছেন প্রায় ৩০ বছর হলো। তাঁর সঙ্গেই প্রথম এই ক্যাম্পাসে আসা। মনে আছে আমরা ক্যানটিনে বসেছিলাম। জীবনের প্রথম লাসানিয়া খাওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল সেদিন। এত দিন পর এখানে এসে বেশ ভালো লাগছে। আজ তোমাদের সঙ্গে কথা বলব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে।
ক্লাসরুমে এআই
কিছুদিন আগেই আমরা একটা বিশেষ প্রকল্প চালু করেছি। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী—তাদের কথা ভেবে প্রকল্পটা সাজানো। শিক্ষার্থী-শিক্ষক, সবাই এখন ভাবছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কীভাবে পাঠ্যক্রমের অংশ করা যায়, কীভাবে ক্লাসরুমে প্রয়োগ করা যায়। তাই আমরা আড়াই কোটি ডলারের একটা অনুদানের ঘোষণা দিয়েছি। এর মাধ্যমে অন্তত পাঁচ লাখ শিক্ষার্থীকে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ সম্পর্কে জানাতে চাই। তারা যদি এই জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পারে, সেটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য বড় ভূমিকা রাখবে।
গুগলে কাজ করার রোমাঞ্চ
গুগলের কাজ কেন আমাকে রোমাঞ্চিত করে? কারণ একজন মানুষ—হোক সে কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক কিংবা ইন্দোনেশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন ছাত্র—তাঁর কাছে যদি কম্পিউটার আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকে, দুজনের কাছেই আমি একই তথ্য পৌঁছে দিতে পারব। এর শক্তি যে কতখানি, সেটা পরিমাপ করা খুব কঠিন। সবার কাছে সমান সুযোগ পৌঁছে দেয় প্রযুক্তি। যে প্রযুক্তিগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এখন আমরা যাচ্ছি, তাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এই প্রযুক্তি কীভাবে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই রোমাঞ্চও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
কার্বনমুক্ত পৃথিবীর খোঁজে
গুগল খুব অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি, যারা ২০০৭ সাল থেকেই নিজেদের কার্যক্রমে কার্বন নিঃসরণ কমাতে কাজ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নিয়ে আসতে চাই। এই সিদ্ধান্ত আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের আগেই নিয়েছিলাম। এখন কাজ এগোচ্ছে আরও দ্রুত। এখন আমরা এক গিগাওয়াটের বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন ডেটা সেন্টার নিয়ে ভাবছি, দুই বছর আগেও কিন্তু এটা সম্ভব ছিল না। আমাদের সব কাজেই জ্বালানি প্রয়োজন। তাই শিগগিরই হয়তো কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সম্ভব। সে জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমাদের তো বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজতে হবে। তবে এটুকু বলতে পারি, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও আমাদের অধিকাংশ ডেটা সেন্টার শতকরা ৯০ ভাগ কার্বনমুক্ত।
ব্যর্থতা কেন দরকার
আপনি যদি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন, আপনার যাত্রায় ব্যর্থতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গুগলে তিনটি বিষয় আমরা সব সময় মাথায় রাখি। প্রথমত, এমন সব উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প হাতে নিতে হবে, যা আগে কেউ করেনি। এর সুবিধা হলো—এতে প্রতিযোগিতায় পড়তে হয় কম। দ্বিতীয়ত, আমাদের কাজ যেন পৃথিবীর সেরা মানুষদের আকৃষ্ট করে। যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। তৃতীয়ত, যা তৈরি করতে চেয়েছিলাম, তাতে যদি শেষমেশ আমরা ব্যর্থও হই তবু এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে যা যা পেয়েছি, তা যেন অমূল্য হয়। এই মানসিকতা আমরা সব সময় রাখতে চেষ্টা করি।
আপনি যদি সব সময় ফলাফলের দিকেই তাকিয়ে থাকেন, তাহলে তো সবাই সহজ-সহজ লক্ষ্য ঠিক করতে চাইবে। যেন অন্তত ব্যর্থ হওয়ার দায় কাঁধে নিতে না হয়। অতএব চেষ্টা করার পুরস্কারও আপনাকে দিতে হবে। লোকে নতুন উদ্যোগ নিক, ঝুঁকি নিক, তাঁকে স্বাগত জানাতে হবে। এই সংস্কৃতি তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনটা এতই দ্রুত হচ্ছে যে আমরা প্রস্তুত হওয়ারও সময় পাচ্ছি না। আজকেই কিছুক্ষণ আগে গ্রুপ ফটো তোলার সময় যখন একটা রোবটকে ডেকে নিচ্ছিলাম এবং চাইছিলাম সে যেন ক্যামেরার দিকে তাকায়, তখনো কিন্তু এর প্রমাণ পেলাম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমরা ব্যবহার করব, তবে সামঞ্জস্য রেখে। আমাদের আসলে ‘পরে ব্যাপারটা সামাল দেব’ ভেবে অপেক্ষা করার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার, প্রতিষ্ঠান, সবারই এ নিয়ে ভাবা উচিত। স্বাস্থ্যসেবার কথাই ধরুন। এর নিজস্ব কিছু বিধান আছে। এসব বিধান টপকে আপনি কাজগুলো এআই-এর হাতে তুলে দিতে পারেন না।
অনেকে প্রশ্ন করে, এআই কি নবীন প্রোগ্রামারদের চাকরি খেয়ে নেবে? আমি মনে করি, তা নয়। এআই বরং প্রোগ্রামারদের কাজে সাহায্য করবে। যেন ছোটখাটো সমস্যার সমাধান করতে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকতে না হয়। সে যেন আরও বড় বড় কাজে মনোনিবেশ করতে পারে। প্রোগ্রামিং যেন আরও সৃজনশীল একটা খাত হয়ে ওঠে।
দাবার কথাই ধরুন। এআই পৃথিবীর যেকোনো মানুষের চেয়ে ভালো দাবা খেলে। কিন্তু তাই বলে কি দাবা খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমে গেছে? বরং ইতিহাসের এই সময়টাতে দাঁড়িয়েই সবচেয়ে বেশি মানুষ দাবা খেলেন।