ভবিষ্যত চিকিৎসকদের প্রতি পরামর্শ
আগামী ১৭ জানুয়ারি ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি বিডিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই পরীক্ষা সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
চিকিৎসা পেশা একদিকে যেমন মানবসেবার চূড়ান্ত রূপ, তেমনি কঠোর পরিশ্রমেরও প্রতীক। যাঁরা মেডিকেলে ভর্তি হতে চান বা এ পেশায় নিজের ভবিষ্যৎ দেখেন, পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক স্থিতিশীলতার প্রতি খেয়াল রাখা তাঁদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।
একজন শিশু-কিশোর মনোরোগবিশেষজ্ঞ হিসেবে এই মেডিকেল ভর্তি যুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক সংগ্রাম আমি কাছ থেকে দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এবং নিজের ডাক্তারি প্রশিক্ষণ পর্বের স্মৃতি থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ ভাগ করে নিচ্ছি।
স্বপ্নপূরণের পথে যাত্রা
প্রথমে বুঝতে হবে, মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার মুহূর্ত থেকেই এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। স্বপ্নপূরণের আনন্দ যেমন থাকবে, তেমনই অনিশ্চয়তার চাপও আসবে। আমার ছাত্রজীবনে তো বটেই, বর্তমানে আমার রোগীদের মধ্যেও দেখেছি, ভর্তি পরীক্ষার জন্য দিন–রাত পড়ে অনেকে মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি বোধ করেন।
আমার কাছে আসা একজন শিক্ষার্থীর উদাহরণ দিই। যথেষ্ট মেধাবী কিন্তু পড়ার চাপ আর দুশ্চিন্তায় তার মধ্যে একটা ভয় কাজ করত। সেটা থেকে অনিদ্রা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাঁকে প্রথম পরামর্শ দিই—নিজের লক্ষ্য এবং সামর্থ্যের ভারসাম্য বজায় রাখতে।
মেডিকেলে পড়ার সময় আমিও দেখেছি, যেসব বন্ধু পড়ার চাপের সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছে, তারাই শুধু পড়াশোনার বাইরে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নও নিতে পেরেছে।
যাঁদের এ রকম দুশ্চিন্তাজনিত সমস্যা আছে, তাঁদের জন্য আমার পরামর্শ:
• পড়ালেখার চেয়েও আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বড়। পরিকল্পিতভাবে পড়াশোনা ভাগ করুন। কোচিং ও নিজস্ব পড়ার সময়কে ভাগ করে নিয়মিত চর্চা করুন।
• ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় ‘পারব না’কে মনে জায়গা দেবেন না।
• প্রতিদিনের পড়া মনে মনে রিভিউ করুন এবং চোখের সামনে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করুন।
মেডিকেল জীবনের বাস্তবতা
মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আপনি কেবল বই পড়ে দক্ষ হবেন না। রোগী দেখার অভিজ্ঞতা আপনাকে বাস্তব জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটাবে। প্রথমবার রোগীর সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, চিকিৎসক হওয়া মানে শুধু পড়াশোনা নয়, এটি একটি গভীর মানবিক সংযোগ।
কিন্তু এখানে রয়েছে চ্যালেঞ্জ—
১. মানসিক চাপ: একবার একজন ছাত্রী আমাকে বলেছিল, ‘ম্যাম, জীবনে প্রথমবার মৃতদেহের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে গিয়েছিলাম। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি।’ এ অনুভূতি খুবই স্বাভাবিক। মানিয়ে নিতে নিজেকে সময় দিন।
২. ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতা: একজন চিকিৎসক হতে গেলে আপনাকে রোগীর কষ্ট, ব্যথা এবং মৃত্যু কাছ থেকে দেখতে হবে। এটি মানসিকভাবে ক্লান্তিকর।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রথমবার অপারেশন থিয়েটারে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে শিখেছি। এই চ্যালেঞ্জগুলোই আমাকে আরও দক্ষ করেছে। রোগীদের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ আপনাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
চাপ ও মানসিক স্বাস্থ্য
মেডিকেলে পড়াশোনা শুরু হলে আসে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনা, ক্লাস ও পরীক্ষার চাপ, রোগীদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার মানসিক প্রস্তুতি এবং ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা একজন শিক্ষার্থীর ওপর অনেক বড় প্রভাব ফেলে। এসব পরিস্থিতিতে মানসিক চাপকে মোকাবিলা করার জন্য কয়েকটি পরামর্শ—
• প্রতিদিনের পড়ার জন্য একটি রুটিন তৈরি করুন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিন।
• মৌলিক বিষয়ে সঠিকভাবে জানুন। যেমন জীববিজ্ঞান, রসায়ন এবং পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন।
• নিয়মিত মক টেস্ট দিয়ে প্রস্তুতি যাচাই করুন। ভুলগুলো পুনর্মূল্যায়ন করুন।
• প্রতিটি বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্ষেপে নোট করুন।
• পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিরতি ছাড়া পড়ালেখার কার্যকারিতা কমে যায়। তাই প্রতিদিন ১০-১৫ মিনিট ধ্যান বা শারীরিক ব্যায়াম তৎক্ষণাৎ আরাম দিতে পারে।
• নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
• নিজেকে ভালোবাসুন। পড়ার পাশাপাশি নিজের শখ এবং মনের আনন্দের জন্য সময় দিন।
রোগীর সুস্থতা দেখে যে তৃপ্তি, অন্য কোনো কাজ থেকে তা পাওয়া সম্ভব নয়। এটি ডাক্তারি পেশায় এক অনন্য দিক। একজন শিশু রোগী এবং তার পরিবারের চোখে যে কৃতজ্ঞতা দেখেছি, সেটি আজও আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
আপনার পেশাগত দক্ষতায় যখন একজনকে সুস্থ হতে দেখবেন, রোগীর পরিবারকে হাসতে দেখবেন, এই আনন্দ আপনার শত দুশ্চিন্তার রাত, শত কষ্টের মুহূর্তকে ভুলিয়ে দেবে।
সবার জন্য আমার দোয়া, শুভকামনা ও ভালোবাসা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিশু-কিশোর ও পারিবারিক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ