ডিজিটাল প্রেসের যুগেও হালিম কেন পুরোনো লেটারপ্রেসটি আগলে রেখেছেন
দেশে সচল লেটারপ্রেস আছে হাতে গোনা। যার একটি চালান ঢাকার মুদ্রাকর হালিম হোসাইন। অফসেট যুগেও মানুষটা কেন পুরোনো প্রযুক্তি আগলে রেখেছেন, জানতে গিয়েছিলেন শেখ ফাতিমা পাপিয়া
ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে ঢুকে মনে হলো বাংলা বর্ণের জাদুঘরে চলে এসেছি। চারপাশে বাংলা মুদ্রণশিল্পের ঐতিহাসিক সব সরঞ্জাম—ধাতু ও কাঠের বর্ণ, ব্লক, আদি বর্ণমালার বই। তবে বাংলা বর্ণমালা ও মুদ্রণ প্রযুক্তি নিয়ে শিল্পী সব্যসাচী হাজরার ‘প্রাইমার টু প্রেস’ নামের এই প্রদর্শনীতে আমাকে সবচেয়ে আগ্রহী করে তুলল একটা লেটারপ্রেস।
প্রদর্শনী কক্ষের এক জায়গায় রাখা যন্ত্রটি মাঝেমধ্যেই খটরমটর আওয়াজ তুলছে। এতে ছাপার কাজ করছেন একজন মুদ্রাকর। কৌতূহলী দর্শনার্থীদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাচ্ছেন কীভাবে লেটারপ্রেস যন্ত্র কাজ করে। আমিও কৌতূহলীদের দলে ভিড়ে গেলাম।
মুদ্রাকরের নাম হালিম হোসাইন। লেটারপ্রেস যন্ত্রে পুরো কাজটি কীভাবে এক হাতে সামলান, সেই সবই খুঁটিনাটি বলছিলেন। পাশের টেবিলে খোপ খোপ বাক্সে রাখা বিভিন্ন বাংলা বর্ণ। সেসব দেখিয়ে মুদ্রাকর বললেন, খোপগুলো থেকে বর্ণ তুলে একটির পর একটি বসিয়ে শব্দ তৈরি করতে হয়। যেমন বই লিখতে হলে ‘ব’ বর্ণের খোপ থেকে ‘ব’ এবং ‘ই’ বর্ণের খোপ থেকে ‘ই’ নিয়ে পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি হয় ‘বই’। এভাবে অনেক শব্দ বসিয়ে তৈরি হয় একটি বাক্য। অনেক বাক্য মিলিয়ে একটা ব্লক। এভাবে আরও কয়েক ধাপ পেরিয়ে ছাপার জন্য লেটারপ্রেসে ওঠে।
বেশ সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য কাজ। ছাপার এই কাজকেই অনেক সহজ করে তুলেছে অফসেট প্রেস। তবু ডিজিটাল প্রেসের এই যুগে যন্ত্রটি আগলে রেখেছেন হালিম হোসাইন। তাই মানুষটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ হলো। দর্শনার্থী কমে এলে নিজেকে মেলে ধরলেন হালিম।
হালিম এলেন লালবাগ
মানিকগঞ্জের ঘিওরে হালিম হোসাইনদের বাড়ি। কৈশোরে একবার লালবাগে মামার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁর মামা হাতেম বিশ্বাসের ছিল প্রেসের ব্যবসা। লালবাগের সেই দোকানের নাম ছিল ‘নিজাম প্রেস’। সেখানে গার্মেন্টস পণ্য, পোস্টার, বইসহ নানা ধরনের ছাপার কাজ হতো। লেটারপ্রেস যন্ত্রে এসব ছাপার যজ্ঞ দেখে ভালো লেগে যায়। মামার দোকানে ছাপার কাজে হাতেখড়ি নেন হালিম।
আস্তে আস্তে লেটারপ্রেসের কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন হালিম। ১৯৮৯ সাল নাগাদ এসে তাঁর মনে হলো আত্মীয়স্বজনের পরিচিত গণ্ডির বাইরে যেতে হবে। মামার প্রেস ছেড়ে তাই বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেন লালবাগেরই আরেকটি প্রেসে। সে প্রেসে বই, নোট, কার্ড, পোস্টারসহ সব ধরনের ছাপার কাজ হতো।
অল্প বেতনের সেই কাজে যোগ দেওয়ার পরই নিজের একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর চিন্তা মাথায় এল। তখন থেকেই বেতনের একটা অংশ জমিয়ে রাখতেন। কয়েক বছর যেতেই কিছু টাকা জমে যায়। এরপর পরিচিতদের মাধ্যমে বিক্রয়যোগ্য লেটারপ্রেস যন্ত্রের খোঁজ নিতে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত থেকে পুরোনো ব্যবহৃত লেটারপ্রেস যন্ত্র দেশে এনে সে সময় বিক্রি করা হতো। পরিচিত একজনের মাধ্যমে মোহাম্মদপুরে এমন একটি লেটারপ্রেসের সন্ধান পান। ৭৫ হাজার টাকায় যন্ত্রটি কিনে নেন হালিম।
১৯৯৫ সালে সেই লেটারপ্রেস যন্ত্র দিয়েই হালিম চালু করেন নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘একতা লেটারপ্রেস’।
মায়ার টানে ছাড়তে পারি নাই
নীলক্ষেতের বাণিজ্য বিতান সুপারমার্কেটের নিচতলায় এখন ‘একতা লেটারপ্রেস’। প্রায় তিন দশক আগে কেনা যন্ত্রটি নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন হালিম হোসাইন। জানালেন, চীনের তৈরি তাঁর লেটারপ্রেস মেশিনটি প্রায় শতবর্ষী। শুরুতে যন্ত্রটি সেলাই মেশিনের মতো পায়ে চাপ দিয়ে চালাতে হতো। একসময় যুক্ত করে নিয়েছেন বৈদ্যুতিক মোটর। এতে কষ্ট কমেছে, কাজও সহজ হয়েছে। আগের মতো এখনো একা একাই এই যন্ত্রে ছাপার কাজ করেন।
দ্রুত কাজের সুবিধার্থে আস্তে আস্তে অফসেট প্রেসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন আমাদের মুদ্রাকরেরা। তবু তাঁর লেটারপ্রেসটি ধরে রেখেছেন হালিম হোসাইন। বলছিলেন, ‘মায়ার টানে ছাড়তে পারি নাই।’
লেটারপ্রেসের রমরমা যুগে কাজের চাপ ছিল বেশি। এখন দিনে হাতে গোনা কাজ পান। তবে আয় আগের চেয়ে বেড়েছে। কয়েক বছর আগেও যেখানে দিনভর কাজ করে পেতেন ৭০০ কি ৮০০ টাকা, এখন দিনে দুটি কাজ করলেই ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আয়।
কারা আসেন তাঁর কাছে? হালিম হোসাইন বললেন, ‘ডিজিটাল প্রেসের কাজ হয়তো অনেক দ্রুত হয়, কিন্তু যাঁরা লেটারপ্রেসের মাহাত্ম্য বোঝেন, তাঁরা আমার কাছেই আসেন। সে হিসেবে আমার ডিমান্ড (চাহিদা) কমে নাই। যত দিন আছি, তত দিন এই কাজের সঙ্গেই থাকব।’