পদে পদে আমাকে শুনতে হতো, আমি সুন্দর নই
সাফল্য দিয়েই ২০২৫ সালের শুরু ভায়োলা ডেভিসের। এ বছর গোল্ডেন গ্লোবসের আসর থেকে পেয়েছেন সেসিল বি ডেমিল পুরস্কার। চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য প্রতিবছর দেওয়া হয় এই বিশেষ আজীবন সম্মাননা। স্বীকৃতি গ্রহণের পর আবেগপ্রবণ এক বক্তব্য দিয়েছেন ভায়োলা। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।
জীবন কেমন? আমার কাছে জীবন হলো বিশাল বপু একটা মানুষের মতো! যে পেটমোটা মানুষটা বিরাট এক হাড়ওয়ালা মাংসের টুকরা চিবুচ্ছে সারাক্ষণ; তার মুখ–হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝোল! মোটা লোকটা একটু নড়াচড়া করলেই তার গা থেকে ঝরে পড়ছে স্বর্ণের টুকরা। সেগুলো গিয়ে পড়ছে ভাগ্যবান কিছু মানুষের ঝুলিতে, যারা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই ভেসে যাচ্ছে সেই স্বর্ণের বৃষ্টিতে। আবার কিছু দুর্ভাগার ওপর এলোপাতাড়িও আছড়ে পড়ে জীবন। ‘পেটমোটা’ জীবনের চাপে পিষ্টও হয় অনেকে! জীবনকে আমি এভাবেই দেখি।
যেভাবে অভিনয়ে
ভীষণ দারিদ্র্যের মধ্যে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। জন্ম থেকেই এমন একটা জীবন পেয়েছিলাম, যার কোনো মানে ছিল না। সেই জীবনে আমি কখনোই খাপ খাওয়াতে পারিনি। ছিলাম পরিবারের সবচেয়ে চঞ্চল সন্তান। বেপরোয়া ছিলাম, ছিলাম কল্পনাপ্রবণ। ভীষণ গরিবও ছিলাম। বড় হতে হতে দেখেছি মাদকের সঙ্গে আমার পরিবারের লড়াই। ঘরে ইঁদুর দৌড়ে বেড়াত। লেগে থাকত অশান্তি। টয়লেটের ফ্লাশ কাজ করত না। ফ্লাশ মেরামতের সামর্থ্যও পরিবারের ছিল না। বালতিতে পানি ভরে টয়লেটে নিয়ে যেতাম।
ছোটবেলায় প্রায় রাতেই বিছানা ভিজিয়ে ফেলতাম। পরদিন সেই ভেজা জামা পরেই কতবার যে স্কুলে গেছি, হিসাব নেই! পদে পদে আমাকে শুনতে হতো, আমি সুন্দর নই। আমি কুৎসিত, অসুন্দর, কদাকার! মোটকথা, জীবনের তখন কোনো মানেই ছিল না। জীবনকে অর্থহীন মনে হতো। সেই ছোট্ট বয়সে জীবনের কাছে শুধু চাইতাম, আমার সামনেও দুয়েকটা স্বর্ণের টুকরা পড়ুক। আমার জীবনটাও একটু অর্থ খুঁজে পাক। কিন্তু না, জীবন আমাকে না স্বর্ণের টুকরা দিয়েছে, না অর্থ। আমার জীবনে এত এত অপ্রাপ্তির ভিড়ে ভালো কিছু বলতে একটা জিনিসই ছিল, আর তা হলো ‘জাদু’। আমি জাদু জানতাম। আমার জাদুর নাম কি জানো? আমার জাদুর নাম ‘কৌতূহল’। কৌতূহলী মন দিয়ে আমি যে কারও জীবনে উঁকিঝুঁকি মারতে পারতাম। নিজের মূল্যহীন জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্য অন্যের জীবনে ঢোকার চেষ্টা করতাম। অন্যকে অনুকরণ করে হুবহু তাঁর মতো লুটোপুটি করে হাসতে পারতাম, অন্যের আনন্দ উপভোগ করতে পারতাম। অন্য একটা মানুষ হয়ে যেতে পারতাম, শুধু কৌতূহল দিয়ে। এটাই ছিল আমার ম্যাজিক! এটাই আমার শক্তি। আমার কৌতূহলী মন। সেই মনই আমাকে অভিনয়ে টেনে এনেছে।
ছোট কাজ, বড় কাজ
বলতে দ্বিধা নেই, শুরুর দিকে শুধু পয়সা কামানোর জন্য অনেক নিম্নমানের ছোট চরিত্রে কাজ করেছি। কারণ, আমার মতো কৃষ্ণবর্ণ, ছড়ানো নাক আর মোটা ঠোঁটের নারীর জন্য ছোট চরিত্রের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু ছিল না। যদি ‘শৈল্পিক, মানসম্মত একটা বড় চরিত্রে অভিনয় দিয়ে কাজ শুরু করব’—এই আশা নিয়ে বসে থাকতাম, তাহলে আজকের অবস্থানে আসা হতো না। মূলত টাকার জন্যই কাজ শুরু করি। আমি বিশ্বাস করি না, দারিদ্র্য থেকে কোনো শিল্পিতা জন্ম নিতে পারে। অভাবের মধ্যে কোনো সৃজনশীলতা নেই, সৃষ্টিশীলতা নেই। অনেক অভাবে জর্জরিত পরিবার দেখেছি, অনেক আত্মীয়কে চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে দেখেছি। সেই অভাব থেকে বাঁচার জন্যই ছোট–বড় যে কাজ পেয়েছি, লুফে নিয়েছি। তাই জীবনে ছোট–বড় যে কাজ পেয়েছি, প্রতিটা কাজের জন্যই কৃতজ্ঞ।
পেটমোটা জীবন
আজকে আমি এখানে কেন? আমার কৌতূহল এখনো আমাকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কেন আজকের এই অবস্থান পর্যন্ত এসে পৌঁছালাম? আমার প্রতিটা চরিত্রে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই। বড় চরিত্র, ছোট চরিত্র, ভালো, বাজে—প্রতিটা চরিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই উত্তর। কারণ, প্রতিটা চরিত্রের জন্যই তো নিজেকে নিংড়ে দিয়েছি প্রতিবার। জীবনের একেকটা টুকরা দিয়ে বুনেছি একেকটা চরিত্র। কোনোটায় ঢেলে দিয়েছি বাবার মৃত্যুশয্যার দিনগুলোতে। কোনোটায় বুনেছি ছেলেবেলার সেই বিছানা ভিজিয়ে ফেলার দুঃসহ স্মৃতি। এভাবে নিজেকে একটু একটু উজাড় করে দিতে দিতেই তো আজ এ পর্যন্ত এসে পৌঁছালাম। আর এই সফরে নিজেকে নিংড়ে দিতে দিতে উপলব্ধি করলাম লেখক জোসেফ ক্যাম্পবেলের একটি কথা, ‘জীবনের কঠিন থেকে কঠিনতম যাত্রায় যখন তুমি সব আশা হারিয়ে ফেল, যখন মনে হয় আর পারছ না, বিপর্যস্ত হয়ে যখন নিজেকে এক গহিন অন্ধকার গুহায় আবিষ্কার করো, তখন দেখবে—আর কেউ নয়; তোমার সহায় শুধু তুমি নিজে।’ ঠিক এ কথাটি হয়ে ওঠে আমার জীবনের অমৃত। আমিই আমার সহায়। ছেলেবেলার সংগ্রাম থেকে শুরু করে, নিজেকে অন্যের ভেতর হারিয়ে ফেলা, ছোট চরিত্রেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া—সবই আসলে নিজেকে আবিষ্কারের অংশ। আমার জীবনের চাবিকাঠি আসলে আমার হাতেই। ওই যে ‘পেটমোটা জীবন’, তার গা থেকে ঝরে পড়া স্বর্ণের টুকরা, সৌভাগ্য—কোনোটাই আমার প্রয়োজন নেই। তুমিই তোমার জন্য যথেষ্ট—প্রয়োজন শুধু এই উপলব্ধি।
ছোট্ট ভায়োলা
অনেকেই বলে, দুজন মানুষের কাছে সব সময় আমরা দায়বদ্ধ। তারা হলো আমাদের ৬ বছরের সত্তা, আর ৮০ বছরের সত্তা। প্রায়ই বাস্তবতাকে হজম করার জন্য আমার ৬ বছরের সত্তার কাছে আমি ফিরে যাই। সে আমাকে জীবনকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে সাহায্য করে, আমাকে আমার শেকড়ের কথা, সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। অভাব–অনটনে বেড়ে ওঠা ছোট্ট ভায়োলার চোখ দিয়ে যখন দেখি, আমি এত সুদর্শন একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছি, আমার একটা ভীষণ আদুরে মেয়ে আছে এবং আমার এমন কিছু বন্ধু আছে যারা সেই ‘বিছানা ভেজানো দুর্গন্ধওয়ালা’ ভায়োলাকে সব জেনেশুনেই ভালোবাসে, সম্মান করে আর সুন্দর মনে করে—বিশ্বাস হয় না। আনন্দ–উল্লাসে ফেটে পড়ে ছোট্ট ভায়োলা। আমার কানে কানে বলে, ‘আমি জাদু জানি, এবার বিশ্বাস হলো তো?’