অবহেলিত শিশুদের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য কাজ করে ‘উৎস বাংলাদেশ’

উৎস বিদ্যানিকেতনে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে এই শিশুরা
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন এক মা। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁর তিন বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে বেশ বিপদেই পড়েছিলেন। ছোট শিশুকে বস্তির বাসায় রেখেও যেতে পারতেন না, আবার সঙ্গে নিয়ে গেলে শুচিবাই গৃহকর্ত্রীর মুখ ভার হতো। অগত্যা কাজে গিয়ে ছেলেকে সেই বাসার বারান্দায় আটকে রাখতেন মা। দিনের পর দিন এভাবে আটকে রাখার ফলে শিশুটির মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা গেল। সে সুযোগ পেলেই গৃহকর্ত্রীর সন্তানকে ঘুষি মারত। কখনো আবার সুযোগ পেয়ে খাবারে বালু মিশিয়ে দিত। ছেলের অদ্ভুত আচরণের কারণে কাজটি টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়ল সেই মায়ের।

এমন সময় পরিচিত একজনের মাধ্যমে ‘উৎস বাংলাদেশ’ নামে এক সংগঠনের খোঁজ পেলেন। সেখানে ছেলেকে পড়াতে পারবেন জেনে অফিসেও গেলেন একদিন। সেখানেও শিশুটি টেবিলের সব জিনিস ফেলে দিল। রেগেমেগে তাকে মারতে চাইলেন মা। মারতে নিষেধ করলেন সামনে বসা ‘উৎস বাংলাদেশের’ প্রতিষ্ঠাতা মাহবুবা মাহমুদ। সঙ্গে সঙ্গে শিশুটি গিয়ে লুকাল মাহবুবা মাহমুদার পেছনে।

মাহবুবা মাহমুদ বলছিলেন, শিশুটির আচরণ নিয়ে আমরা পরে বিশদ খোঁজ নিয়েছিলাম। তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেল, সে সব সময় নিজেকে অবহেলিত হতে দেখেছে। এই ছোট শিশু তো সমাজের শ্রেণি বোঝে না, সে বোঝে বৈষম্য। পরবর্তীকালে শিশুটিকে উৎস বিদ্যানিকেতনে ভর্তি করানো হয়েছিল। ধীরে ধীরে সে তার স্বাভাবিক শৈশবে ফিরেছিল। আমাদের স্কুলে তখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তই সে পড়েছে।

উৎস বিদ্যানিকেতনের শিশুরা খেলাধুলাসহ নানা সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে
ছবি: সংগৃহীত

উৎস বিদ্যানিকেতনের পড়তে আসা এমন আরও কয়েকজন শিশুর গল্প শোনালেন মাহবুবা মাহমুদ। ১৯৯৩ সালে তিনিসহ কয়েকজন মিলে চালু করেন উৎস বিদ্যানিকেতন। ৩০ বছর পেরিয়ে আসা সংস্থাটির কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে এখন। শুরুতে ভাড়া বাসায় উৎস বিদ্যানিকেতন শুরু হলেও বর্তমানে গাজীপুরের শ্রীপুরে রয়েছে নিজস্ব ক্যাম্পাস। প্লে থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত আবাসিক লেখাপড়ার সুবিধা পাচ্ছে ৮৫ শিশু–কিশোর। অনাবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর কয়েক গুণ।

যাদের কেউ এসেছে চার বছর বয়সে, কেউ এসেছে আরেকটু বড় হয়ে। কারও হয়তো অভিভাবক নেই, কারও কেটেছে ভয়ংকর শৈশব; কিন্তু এই আবাসিক স্কুলে এসে সবাই সমান মর্যাদা পায়। পড়ালেখার পাশাপাশি শেখে কারাতে, নাচ, গান, আবৃত্তি, সাইক্লিংসহ সৃজনশীল নানা কিছু। মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে তাদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা হয়।

এ ছাড়া রাজধানীর রায়েরবাজারেও আরেকটি প্রাইমারি স্কুল পরিচালনা করে উৎস বাংলাদেশ।

শিশুদের সঙ্গে মাহবুবা মাহমুদ
ছবি: সংগৃহীত

আস্থা দিবাযত্ন কেন্দ্র

সন্তানকে নিরাপদে রেখে কর্মস্থলে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটা পেশাজীবী মায়েদের চেয়ে আর ভালো কে জানে। এর মধ্যে ঢাকায় স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী নারীদের চ্যালেঞ্জটা আরও বেশি। তাঁরা চাইলেই বস্তির বাসায় সন্তানকে রেখে যেতে পারেন না। আবার দিবাযত্নকেন্দ্রে রাখার মতো সাধ্যও নেই। কর্মজীবী এমন মায়েদের জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ২০১৬ সালে বস্তিকেন্দ্রিক ‘আস্থা দিবাযত্ন কেন্দ্র’ তৈরি করে উৎস বাংলাদেশ। বর্তমানে ঢাকায় ৬টি ও গাজীপুরে ১টি দিবাযত্ন কেন্দ্রের কার্যক্রম চলমান। ছয় মাস থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুরা এখানে থাকতে পারে। মূলত পোশাক কারখানায় কাজ করা নিম্ন আয়ের মায়েরা এখানে সন্তানকে রেখে কাজে যান। স্বল্প খরচে দুই বেলা খাবার ও খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকে এসব কেন্দ্রে।

আস্থা দিবাযত্ন কেন্দ্রের দুই শিশু
ছবি: সংগৃহীত

উৎসের জন্য গাইবেন তরুণ তিন শিল্পী

উৎস বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই থেকেই টেকসই অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করে গেছে। এ জন্য সাহায্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে। সে উদ্যোগে সফলও হয়েছে সংস্থাটি। উৎসের নিজস্ব কিছু উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো ‘উৎস কিচেন’। বাসাবাড়ি, অফিস ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করা হয় এর মাধ্যমে। এ ছাড়া আছে ‘উৎস গ্রোসারি এবং এগ্রো’। এই উদ্যোগের মাধ্যমে টাটকা সবজি বাসায় পৌঁছে দেয় তারা। এ ক্ষেত্রে নিজেদের উৎপাদিত সবজিও দেওয়া হয়। ‘উৎস টেইলরিং’ পোশাক বানিয়ে আয় করে। একই সঙ্গে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আবাসিক শিক্ষার্থীদের। এসব প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়লে সেটিও সরাসরি শিশুদের উন্নয়নে সাহায্য করবে।

উৎস বাংলাদেশের সদস্যসচিব শ্রাবন্তী দত্ত জানালেন, নিজেদের উদ্যোগের পাশাপাশি কয়েকটি উপায়ে তাঁরা সংস্থা অনুদান গ্রহণ করেন। উৎস বিদ্যানিকেতনের আবাসিক শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিতে পারেন দাতারা। অর্থাৎ একজন শিশুর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন একজন দাতা সদস্য। সে ক্ষেত্রে ওই শিশুটির মাসিক খরচ পাঠাতে হবে কমপক্ষে এক বছরের জন্য। এ ছাড়া অনেকে প্রিয়জনের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীসহ বিশেষ দিন উপলক্ষে অর্থ প্রদান করেন। অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি জাকাতের অর্থও গ্রহণ করে।

এর বাইরে নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে সংস্থাটি। যেমন আসছে ২৫ অক্টোবর রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ কমপ্লেক্সে ‘উৎস সন্ধ্যা ২০২৪’ শীর্ষক আয়োজন করা হয়েছে। এখানে গান গাইবেন তরুণ তিন সংগীতশিল্পী—ঋতুরাজ, নন্দিতা ও মাশা ইসলাম। প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু–কিশোরদের কল্যাণে তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে এই আয়োজন করা হচ্ছে।