রেস্তোরাঁয় এই আচরণগুলো একেবারেই করবেন না

রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রায়ই না বুঝে অনেকে এমন সব আচরণ করেন, যা করা একেবারেই অনুচিত। অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতো রেস্তোরাঁয় খেতে আসা অতিথিদের জন্যও রয়েছে কিছু অলিখিত নিয়ম। অবশ্য নিয়ম না বলে শিষ্টাচার বলাই ঠিক হবে। বুড়িগঙ্গা রিভারভিউ রেস্তোরাঁর হেড অব অপারেশন মিজানুর রহমান বলছিলেন, ‘অতিথিরা শিষ্টাচার রক্ষা না করতে পারলে আমাদের আসলে কিছুই বলার থাকে না।’ আসুন জেনে নেওয়া যাক, অতিথি হিসেবে কোন আচরণগুলো রেস্তোরাঁয় করা একেবারেই ঠিক নয়।

রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রায়ই না বুঝে অনেকে এমন সব আচরণ করেন, যা করা একেবারেই অনুচিতছবি: পেক্সেলস

১. বখশিশ দিতে অনীহা
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ইউরোপের অনেক দেশের মানুষ বকশিশ নিয়ে বেশ বিরক্ত। কেননা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার পর তাঁদের বাধ্যতামূলক বকশিশ গুনতে হয় খাবারের দামের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। সেখানকার বেশির ভাগ সাধারণ মানুষই মনে করেন, এটি অতিরিক্ত। এদিকে আবার এশিয়ার দেশ চীন, জাপান, কোরিয়ায় কোনো কাজের বিনিময়ে আলাদা করে বকশিশ দেওয়াকে অপমানজনক হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশে অবশ্য বকশিশ নিয়ে এমন কোনো কঠিন বাধ্যবাধকতা নেই। আজকাল অবশ্য রসিদে আলাদাভাবে ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ যোগ করে অনেক রেস্তোরাঁ। তবে যদি না করে, সে ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি আপনাকে খাবার পরিবেশন করছেন, তাঁকে খুব বেশি না হলেও কিছু বকশিশ দিতে পারেন।

২. জায়গা না থাকলেও ভিড় করা
মধ্যাহ্নভোজের সময় রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে দেখলেন বসার জায়গা নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আপনার মতো হয়তো অনেকেই অপেক্ষারত। এ সময় যাঁরা টেবিলে বসে খাচ্ছেন, তাঁদের টেবিলের কাছে ঘোরাঘুরি না করাই উত্তম। টেবিল থেকে দূরে কোনো জায়গা থাকলে সেখানে অপেক্ষা করুন। নয়তো একটা কাজ করতে পারেন, কাউন্টারে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে টেবিল খালি হলে জানাতে বলে বাইরে কিছুক্ষণ হেঁটে আসতে পারেন। এতে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হতে হবে না, সঙ্গে ক্ষুধাটাও বেশ চাঙা হয়ে উঠবে।

রেস্তোরাঁর খাবারের তালিকার বাইরে কোনো খাবার না চাওয়াই শ্রেয়
ছবি: পেক্সেলস

৩. খাওয়া শেষ করেও বসে থাকা
বিশেষ করে দুপুর ও রাতের খাওয়ার সময় রেস্তোরাঁগুলোর ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। এ সময় খাওয়া শেষ হলে শুধু শুধু বসে না থেকে অপেক্ষারত অন্য অতিথির জন্য দ্রুত টেবিল ছেড়ে দেওয়া উচিত।

৪. রেস্তোরাঁর রুমালে হাঁচি-কাশি দেওয়া
রেস্তোরাঁর টেবিলে আপনার সামনে যে কাপড়ের রুমাল দেওয়া হয়েছে, সেটি শুধু আপনার পোশাক রক্ষার্থে ব্যবহারের জন্য। আগেও এটি অন্য অতিথি ব্যবহার করেছেন এবং ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করা হবে। তাই কোনোভাবেই রেস্তোরাঁর দেওয়া রুমালে হাঁচি-কাশি দেওয়া যাবে না।

৫. অসুস্থ অবস্থায় রেস্তোরাঁয় যাওয়া
ঠান্ডা, জ্বর, হাঁচি, কাশি, সর্দির মতো হালকা রোগ থাকলেও রেস্তোরাঁয় না যাওয়াই উত্তম। আপনার মাধ্যমে কে কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে যাবেন, কে বলতে পারে?

৬. খাওয়ার পর প্লেট-গ্লাস গোছানো
অবাক হলেন, তাই না? ভেবেছিলেন এটা তো ভালো কাজ। ওয়েটারের কাজ কমিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। ‘এটি আসলে শিষ্টাচার লঙ্ঘন,’ বলেন আতিথেয়তা প্রশিক্ষক লেসলি কাল্ক। বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেন, প্লেট-গ্লাস গুছিয়ে একত্র করলে এটা আসলে ইঙ্গিত করে যে রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা ঠিকভাবে তাঁদের কাজ করছেন না। তা ছাড়া প্লেট-গ্লাস সঠিকভাবে পরিপাটি করে গুছিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ওয়েটাররা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। তাই তাঁদের কাজ তাঁদেরই করতে দিন। এরপর কোনো রেস্তোরাঁয় গেলে খাবার উপভোগ শেষে পিছিয়ে বসুন, ওয়েটারকে টেবিল গোছানোর অনুমতি দিন।

৭. মেনুর বাইরে খাবার চাওয়া
ধরুন আপনি বিরিয়ানির সঙ্গে বোরহানি খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখলেন সেখানে আছে কোমল পানীয়। আপনি যদি এখন বোরহানি দাবি করেন, তাহলে সেটি হবে অপ্রত্যাশিত আচরণ। তাই রেস্তোরাঁর খাবারের তালিকার বাইরে কোনো খাবার না চাওয়াই শ্রেয়।

৮. ছেলেরা যদি আগে নিজের খাবার পছন্দ করে
আধুনিকতায় এটি ধরার মতো তেমন কিছু নয়। এটি পুরোটাই আসলে আচার-শিষ্টাচার ও শোভনীয়তা রক্ষার ব্যাপার। কাল্ক বলেন, পুরুষের উচিত, সঙ্গে থাকা নারীকে আগে খাবার পছন্দ করতে দেওয়া। তবে যদি তিনি প্রস্তুত না থাকেন এবং মেনু দেখার জন্য সময় চান, তাহলে পুরুষ আগে অর্ডার করতে পারেন।

খাওয়া হলে টাকা পরিশোধের জন্য আপনি প্রস্তুত, এটি কাউকে ডেকে জানাতে হবে
ছবি: পেক্সেলস

৯. পাশেরজনের গ্লাস থেকে পান
প্লেট-গ্লাস সাজানো টেবিলে বসলে কোন পাশেরটা যে নিজের গ্লাস আর কোনটা পাশেরজনের, বুঝতে অনেকেই ঝামেলায় পড়েন। এ সমস্যার সহজ সমাধান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পেশাদার শিষ্টাচার প্রশিক্ষক এবং ‘ম্যানর অব ম্যানার্স’ বইয়ের লেখক মেরিয়ান পার্কার। বলেন, আপনি যেখানে বসেছেন, তার ডানে রাখা গ্লাস থেকে পান করুন এবং ডানেই রাখুন। এতে অন্য কারও গ্লাস নিয়ে নেওয়ার শঙ্কা কম থাকবে।

১০. খাওয়া শেষে বিলের জন্য চুপচাপ অপেক্ষা
খাওয়া শেষ করে চুপচাপ বসে থেকে যদি ভাবেন যে এমনিই কেউ বিল দিয়ে যাবেন, তাহলে ভুল করবেন। রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা আপনার বসে থাকা লক্ষ না–ও করতে পারেন। এতে আপনারই সময় নষ্ট হবে। তাই খাওয়া হলে টাকা পরিশোধের জন্য আপনি প্রস্তুত, এটি কাউকে ডেকে জানাতে হবে।

১১. বিল নিয়ে টানাটানি
কয়েকজন মিলে একসঙ্গে খেতে গিয়ে কে দাম পরিশোধ করবে, তা নিয়ে অনেক সময়ই তর্কাতর্কি বেধে যায়। এটা রেস্তোরাঁর কর্মীদের সময় নষ্ট করে। তাই সঙ্গীদের আগে থেকেই জানিয়ে দিন, আজকে আপনি খাওয়াচ্ছেন।

১২. উত্তেজক বিষয়ে কথোপকথন
রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে একেকজনের একের রকম মতাদর্শ থাকে। এসব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যে ঝগড়া বাধবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। রেস্তোরাঁয় বসে এমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত নয়, যা কলহ সৃষ্টি করতে পারে।

১৩. অন্যের খাবার আসার আগেই খাওয়া শুরু করা
পার্কস বলেন, ‘সঙ্গের ব্যক্তিদের খাবার আসার আগে যদি আপনার খাবার দিয়ে যায়, তাহলে কোনোভাবেই একা একা খাওয়া শুরু করা যাবে না।’ খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকলে অন্যরা অনেক সময় হাসাহাসি করেন। তবে এটি শিষ্টাচারের অংশ। অবশ্য অনেকের খাবার চলে এলেও কয়েকজনেরটা আসতে দেরি হলে অপেক্ষারত ব্যক্তিদের অনুমতি নিয়ে বাকিরা খাওয়া শুরু করতে পারেন।

অন্যদের বিরক্তির কারণ হতে না চাইলে রেস্তোরাঁয় সঙ্গীদের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলুন
ছবি : প্রথম আলো

১৪. উচ্চ স্বরে কথা
ভালো কিছু সময় কাটাতে আপনি রেস্তোরাঁয় গেছেন। সেখানে যদি দেখেন, অনবরত কেউ উচ্চ স্বরে কথা বলে যাচ্ছেন, তাহলে আপনার কেমন লাগবে? অবশ্যই খারাপ। অন্যদের বিরক্তির কারণ হতে না চাইলে সঙ্গীদের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলুন।

১৫. হাততালি বা আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে ওয়েটারকে ডাকা
এটি অপমানজনক আচরণ। বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। ওয়েটার নিজে থেকে না এলে হাততালি কিংবা তুড়ি বাজিয়ে শব্দ না করে এক হাত তুলে নিঃশব্দে ইশারা করুন।

১৬. খাবার নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢোকা
আপনি যেখানে খেতে গেছেন, সেখানে বাইরের খাবার নিয়ে প্রবেশ করা একেবারেই ঠিক নয়। অনেকেই বাইরে থেকে পানি কিংবা কোমল পানীয় কিনে নিয়ে রেস্তোরাঁয় যান। এটি রেস্তোরাঁর প্রতি অসম্মানজনক আচরণ। অতিথিদের উদ্দেশ্যে এমনটি না করার অনুরোধ করেছেন মিজানুর রহমান।

‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ থেকে