বাগমারার একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা
একাত্তরে রিয়াজ উদ্দিন থান্দারের বাড়ি ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের রামরামা গ্রামের বাড়িটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা এসে থাকতেন। তাঁর বাড়ি থেকেই বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিতেন। এ জন্য তাঁকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়েছিল মিলিটারিরা। ভাগ্যক্রমে সেবার প্রাণে বেঁচে যান রিয়াজ উদ্দিন। আর এসবই খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর বড় সন্তান শামসুন নাহার। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ কি ১৬ বছর। বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাশুশ্রূষা করতেন তিনি। কোনো মুক্তিযোদ্ধা অসুস্থ হলে তাঁর সেবার দায়িত্বও তার ওপর পড়ত। সেবা দিয়ে তাঁদের সুস্থ করে তুলতেন। এলাকার ভেতরে কোথাও অপারেশন হলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে দিতেন এই নারী। এভাবে একসময় নিজেই কখন জানি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠেন শামসুন নাহার। ৭ নম্বর সেক্টরের ঝিকড়ার লাহেড়িবাড়ি এলাকায় অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। তাঁর মামা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বার এই কাজে সহযোগিতা করেন। যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আলী খাজা এম এ মজিদ।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুসারে, বাগমারা উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫০৬। এর মধ্যে শামসুন নাহার তালিকাভুক্ত একমাত্র নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা। তবে এই স্বীকৃতির জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৪ বছর। ২০০৫ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে তালিকাভুক্ত করা হয়।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে একাত্তরের গল্প করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শামসুন নাহার। তিনি স্মৃতিচারণা করেন, যুদ্ধকালীন অনেক স্মৃতি রয়েছে। নাটোরের নলডাঙ্গা এলাকায় যুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পাটের বস্তায় ভরে অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখে পড়েন। তাঁদের চোখ এড়াতে পাটখেতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পাটখেতের অদূরেই শুরু হয় যুদ্ধ। ভেসে আসে গুলির শব্দ। সারা রাত সেখানেই ছিলেন, কয়েকবার অচেতনও হয়ে পড়েন। ভাবছিলেন আজকেই বুঝি তাঁর মৃত্যু হবে। ভোরে অস্ত্র নিয়ে বাড়ি ফেরেন। সেদিনের স্মৃতি আজও তাঁকে তাড়া করে। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছেন শামসুন নাহার। কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ওই সময় হারিয়েছেন তিনি।
শামসুন নাহার বলেন, যুদ্ধে স্বাধীন দেশ ছাড়াও নতুন সংসারও পেয়েছেন। যুদ্ধের সময় শাহার আলী সরদার নামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ২২ কিলোমিটার দূরের ঝিকড়া এলাকায় তাঁর বাড়ি। যুদ্ধের সময়ে অসুস্থ হয়ে এলে তাঁর সেবার দায়িত্ব শামসুন নাহারের ওপরে পড়ে। তাঁকে সেবা করে সুস্থ করে আবারও যুদ্ধে পাঠিয়ে দেন। তখন থেকেই মন দেওয়া-নেওয়া। স্বাধীনতার পর বিয়ে। ১৯৯০ সালে মারা যান শাহার আলী। এক ছেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন, এটাই শামসুন নাহারের কাছে অনেক বড়। নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলাদা করে দেখা হয় না। তবে এ বছর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোনো স্বাধীনতাবিরোধী যেন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত না হয়।
শামসুন নাহারের ছেলে স্কুলশিক্ষক শামসুজ্জামান বলেন, তাঁর মা উপজেলার একমাত্র নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা, এটা জেনে খুব গর্ব হয়। এখনো তাঁর মায়ের কাছ থেকে ওই সময়ের বিভিন্ন গল্প শোনেন। একজন নারী হয়ে যুদ্ধের মাঠে তিনি যেভাবে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, সেটা তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালে শামসুন নাহারকে তাঁরা সাহসী নারী হিসেবে দেখেছেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা ছাড়াও যুদ্ধে অংশ নিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। তিনিই একমাত্র তালিকাভুক্ত নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা।