২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

‘মেয়েটার মধ্যে একটা কিছু আছে…ও অন্য রকম’

আবারও বর্ষসেরা নারী ফুটবলার হলেন বার্সেলোনা ও স্পেনের তারকা অ্যালেক্সিয়া পুতেয়াস। টানা দ্বিতীয়বার এই পুরস্কার জিতলেন তিনি। ৮ মার্চ নারী দিবস সামনে রেখে পড়ুন এক অনুপ্রেরণাদায়ী ক্রীড়াবিদের বেড়ে ওঠার গল্প।

অ্যালেক্সিয়া পুতেয়াস
ছবি: এএফপি

ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল বার্সার হয়ে খেলব। যখন সত্যিই এই ক্লাবে খেলা শুরু করলাম, মনে হলো আমি আমার পরিবার, ঘর, পূর্বপুরুষের প্রতিনিধিত্ব করছি।

৬ বছর বয়সে বিলিয়ার্ড বোর্ডের ওপর দাঁড়িয়ে এল ক্লাসিকো দেখার একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে। আমার পুরো পরিবারই ছিল বার্সেলোনার বড় ভক্ত। স্টেডিয়ামে যাওয়া হতো না। বার্সেলোনার মইয়েৎ দেল ভাইয়েসে আমাদের বাড়ির পাশে লা বোলেরা নামে একটা বার ছিল। বড় বড় খেলার সময় লোকের ভিড়ে সেখানে পা রাখা যেত না। বাবা তখন আমাকে বিলিয়ার্ড বোর্ডের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতেন, যেন আমিও বড় পর্দায় খেলা দেখতে পারি। আমার কেমন ভয় ভয় করত। খেলাটেলা অত বুঝতাম না। কিন্তু বুঝতাম, বিরাট কোনো একটা ঘটনা ঘটছে।

আমার ধারণা ছিল, ক্যাম্প ন্যু (স্পেনের বার্সেলোনার একটি বড় স্টেডিয়াম—বি.স.) শুধু ছেলেদের জন্য। ছোটবেলায় মা-বাবা, চাচা-চাচি, দাদা-দাদু, আমরা সবাই মিলে বাসে চড়ে খেলা দেখতে যেতাম। যতটা সম্ভব মাঠের কাছাকাছি বসতে চাইতাম, যেন খেলোয়াড়দের কাছ থেকে দেখা যায়। তখন যদি কেউ আমাকে বলত, একদিন তুমিও ওই সবুজ ঘাসে পা রাখবে, বিশ্বাসই করতাম না! বলতাম, ‘যাহ! ওখানে কি মেয়েরা যায় নাকি!’ সেই মাঠেই আমি খেলেছি গত বছর। ড্রেসিংরুম কিংবা মধ্যমাঠে দাঁড়িয়ে তখন ৬ বছর বয়সী আমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার।

অ্যালেক্সিয়া পুতেয়াস
ছবি: এএফপি

কখনো প্লাজা, কখনো রাস্তায়

‘মেয়েটার মধ্যে একটা কিছু আছে…ও অন্য রকম,’ এমন কথা প্রায়ই শুনেছি। কখনো কান দিইনি। আমার মনোযোগ ছিল শুধু খেলায়। যেখানে, যেভাবে পেরেছি, খেলেছি। মা-বাবা হয়তো কোনো প্লাজায় গেছেন কফি খেতে। ঠিকই সঙ্গে বল নিয়ে গিয়েছি। টাউন হলের দেয়ালের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ বলে লাথি মেরে গেছি। একসময় ঘেমেনেয়ে, ক্লান্ত হয়ে মা-বাবার কাছে গিয়ে বলেছি, ‘পানি দাও!’

রাস্তায় এত বেশি খেলতাম যে পায়ে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল। মা বলতেন, ‘ওর পা দুটো বাঁচানোর জন্য হলেও ওকে একটা ক্লাবে ভর্তি করা দরকার।’ (তাতে অবশ্য লাভ হয়নি। ক্লাবে নাম লেখানোর পরও আমি রাস্তায় খেলে গেছি এবং পায়ে আরও দাগ পড়েছে। হা হা!)

আমার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল একটা নির্দোষ মিথ্যা দিয়ে। মা-বাবা আমাকে সাবাদেল ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলেন, কারণ সেখানে একজন পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। ক্লাবে ঢোকার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ছিল ৮। আমার তখন ৭। অতএব একটু মিথ্যা বলেই আমাকে ভর্তি করা হয়েছিল। ১১-১২ বছর বয়সী মেয়েদের সঙ্গে খেলতাম। প্রতিদিনই বাড়ি ফিরে অভিযোগ করতাম, বলে ওদের মতো অত জোরে কেন লাথি মারতে পারি না!

অ্যালেক্সিয়া পুতেয়াস
ছবি: সংগৃহীত

ধন্যবাদ পরাজয়

যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন অনুশীলন করে ঠিক মন ভরত না। সকালে ক্লাস করে সন্ধ্যায় অনুশীলনে যেতাম। মন পড়ে থাকত ফুটবলে। যদি সম্ভব হতো, ২৪ ঘণ্টাই অনুশীলনে কাটাতে চাইতাম।

বার্সেলোনা মেয়েদের ওপর বিশ্বাস রেখেছিল। ২০১২ সালে আবার যখন বার্সায় যোগ দিলাম, তখন দলের অবস্থা ভালো না। কয়েক বছর আমরা কোনো বড় ম্যাচ জিততে পারিনি। মেয়েদের পেছনে এত বিনিয়োগ করা ঠিক হচ্ছে কি না, তা পুনর্বিবেচনার বদলে তারা বরং আরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। খুব জলদিই আমরা ভালো ফল আনতে পারিনি। কিন্তু তারা জানত, সাফল্য পেতে সময় লাগে।

২০১৯ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে লিও আমাদের রীতিমতো গুঁড়িয়ে দিল। এই পরাজয়টা সত্যিই খুব সাহায্য করেছে। লিওকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ওরাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, ফুটবল কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। হারার পর বুঝতে পেরেছিলাম, ‘আচ্ছা, আমাদের তাহলে ওখানেই যেতে হবে।’ গন্তব্যটা জানতাম বলেই বুঝতে শুরু করেছিলাম, আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে।

কিসের ইনজুরি

২০২১ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলেছিলাম ইনজুরি নিয়ে। ফাইনালের তিন দিন আগে টের পেলাম, হ্যামস্ট্রিংয়ের অবস্থা ভালো না। কোচ এবং মেডিকেল টিমের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা বলল, আমার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করবে। পরের দিনও ব্যথা নিয়েই অনুশীলনে নামলাম। কিন্তু ১০ মিনিট পরই আর পা নাড়াতে পারছিলাম না। চোখের সামনে আমার স্বপ্নের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

খেলার ২৪ ঘণ্টা আগে আমি মনের অনুশীলনের ওপর জোরে দিলাম। নিজেকে বলতে শুরু করলাম, ‘আমার কিছুই হয়নি।’ এবং সত্যি সত্যিই একসময় কথাটা বিশ্বাস করতে লাগলাম। আশপাশের সবাইকে বলতে শুরু করলাম, ‘কিসের ইনজুরি? এই নিয়ে আমার সঙ্গে কোনো কথা বলতে এসো না।’ খেলা শেষ হওয়ার পর দুই সপ্তাহ মাঠের বাইরে ছিলাম। ক্ষতি যা হয়েছিল, তা আমার ধারণার চেয়ে বেশি। তবু মনে হয়েছে কষ্টটা সার্থক। এমনকি ম্যাচ শেষের উদ্‌যাপনের সময়ও আমি হ্যামস্ট্রিংয়ে কিছু অনুভব করিনি।

নিশ্চিত ছিলাম, আমরা চেলসিকে হারাতে যাচ্ছি। এটা এমন একধরনের নিশ্চয়তার অনুভূতি, আমি বলে বোঝাতে পারব না। পেনাল্টি কিক নিতে যাওয়ার সময়ও আমার ভেতরটা ছিল একদম শান্ত। মনেই হচ্ছিল বলটা জালে যাবে, আর আমরা জিতব।

এমনই তো হওয়া উচিত

চাপও একধরনের নেশা। আমি সব সময় জিততে ভালোবাসি। পরাজয়টা একদমই নিতে পারি না। বার্সায় ১০ বছর খেলার পর যেকোনো খেলোয়াড়ের মধ্যেই এই মনোভাবটা চলে আসে। প্রত্যেকটা খেলা জিততে হবে—এর কোনো বিকল্প নেই।

ফুটবলের কোনো ‘লিঙ্গ’ নেই। মইয়েৎ-এ আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম, যে প্লাজা বা পার্কে ছেলেদের সঙ্গে খেলত। কিন্তু কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। কেউ কখনো বলেনি, তুমি খেলতে পারবে না। ফুটবলার হতে চাই শুনে কেউ কোনো দিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়নি। আমি জানি, এ রকম একটা পরিবার বা বন্ধুদের মধ্যে বেড়ে ওঠা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু প্রত্যেক মেয়ের ক্ষেত্রে এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। নতুন প্রজন্মের উচিত ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া। এটা বিশ্বাস করা যে ফুটবল সবার।

ছেলেবেলায় যেই বাসে চড়ে খেলা দেখতে যেতাম, অবসর নেওয়ার পর সেই একই বাসে আমি বাড়ি ফিরে যাব। হয়তো আবার সেই বাসে চড়েই মাঠে আসব পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের খেলা দেখার জন্য।

সবকিছুই নির্ভর করে চাহিদা আর জোগানের ওপর। আগে মানুষ বলত, মেয়েদের ফুটবল কে দেখবে? এখন নারী ফুটবলার আছে বলেই মানুষ মেয়েদের খেলা দেখতে চায়। ২০ বছর ধরে খেলছি। এই ২০ বছরে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। আপনি যদি মনে করেন, নারী ফুটবলে এখন যথেষ্টসংখ্যক মেয়েরা যুক্ত হচ্ছে, ভবিষ্যতে আজকের দিনের কথা ভেবে আপনার হাসি পাবে। কারণ, তখন সংখ্যাটা হবে অবিশ্বাস্য। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনূদিত

সূত্র: প্লেয়ারস ট্রিবিউন