দিনমজুরি করে জমানো সব টাকা মসজিদে দান করে দিলাম

আপনজনদের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন কিশোরগঞ্জের মুর্শিদ মিয়া। প্রায় ৩২ বছর পর মনের কষ্ট ভুলে বাড়ি ফিরেছেন ৭০ বছর বয়সী মানুষটা। তাঁর নিখোঁজ জীবনের গল্প শুনতে গিয়েছিলেন তাফসিলুল আজিজ

৩২ বছর পর মনের কষ্ট ভুলে বাড়ি ফিরেছেন মুর্শিদ মিয়া
ছবি: লেখক

আমি পাকুন্দিয়ার দক্ষিণ চরটেকি এলাকার মানুষ। লেখাপড়া করা হয় নাই। নিজেদের জমিজিরাত যা ছিল, সেগুলোই চাষবাস করতাম। বাবা মারা যাওয়ার পর এই জমিজিরাতের ভাগাভাগি নিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হতো। আমার বউও এই নিয়ে নানা সময়ে খোঁটা দিয়ে কথা বলত। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পার হলেও আমাদের কোনো সন্তান ছিল না। এসব নিয়েও কথা শোনাত। অথচ পাশের বাড়িতেই বিয়ে করেছিলাম। সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন।

জমি নিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদ আর তা নিয়ে বউয়ের কথা শুনতে শুনতে অস্থির লাগত। একদিন আর পারলাম না। আমার বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে রাগে-ক্ষোভে ঘর ছাড়লাম। সেটা ১৯৯১ কি ৯২ সাল হবে।

আরও পড়ুন
বাড়ি ফেরার পর মুর্শিদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে অনেকেই আসছেন
ছবি: লেখক

আগে গেলাম কিশোরগঞ্জে। স্টেশনে গিয়ে একটা লোকাল ট্রেনে উঠে পড়ি। নরসিংদী স্টেশনে গিয়ে নামলাম। এত দিন আগের কথা তো, অনেক কিছু ভুলে গেছি। মনে আছে, নরসিংদী স্টেশনে একজনের সঙ্গে পরিচয় হইছিল। লোকটা কামলা খাটত। তার সঙ্গে চলে যাই বেলাবর ধুকুন্দি। এই গ্রামের শাহাবুদ্দীন মাস্টারের বাড়িতে কামলার কাজ করত লোকটা। মাস্টারের বাড়িতেই কখনো মাটি কাটা, কখনো ধান কাটার কাজ করতে থাকি। মাস্টারের বাড়িতে কাজ না থাকলে গ্রামের অন্য বাড়িতে কাজ নিতাম। ব্যাগে দু–একটা কাপড় আর কাঁথা-বালিশ থাকত। স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, বাজারের দোকান—যেখানে সুযোগ পেতাম, সেখানেই ঘুমাতাম।

মাঝেমধ্যে বাড়ির কথা মনে পড়ত। তবে বড় ভাই-ভাবি আর স্ত্রীর কথা মনে হলে আর ফিরতে ইচ্ছা হতো না। বাড়ির কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। এভাবে কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর মনে হলো, গ্রামে আর ফিরবই না। ভাবতাম, আমার মা হয়তো আর বেঁচে নেই, স্ত্রীরও হয়তো অন্য জায়াগায় বিয়ে হয়ে গেছে। সন্তানাদিও নেই, বাড়ি ফিরে কী করব।

আরও পড়ুন
পুলিশের সহযোগিতায় বাড়ি ফিরেছেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার মুর্শিদ মিয়া (ডান থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: প্রথম আলো

দিনে দিনে ধুকুন্দি আর আশপাশের গ্রামের মানুষ আমার আপন হয়ে যায়। বছর দশেক আগে রায়পুরা থানার শিবপুর বাজারে চলে যাই। সেখানে প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় বেশির ভাগ সময় থাকতাম। মাঝেমধ্যে মাদ্রাসাতেও থেকেছি। একা মানুষ তেমন কোনো খরচ নেই। দিনমজুরি করে যা আয় হয়, সব জমা থাকে; কিন্তু কখনো মনে হয় নাই একটা বাড়ি করি।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে নানা রোগ বেঁধেছে। সবকিছু মনেও রাখতে পারি না। খুব একা লাগত। বাড়ির জন্য মন কেমন করত। মাঝেমধ্যে মনে হতো, আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। অনেক বছর ধরেই আল্লাহর ঘরে আমার সব উপার্জন দান করে দেব বলে মনস্থির করছিলাম। সেই ইচ্ছা পূরণ করতে গত বছর নিজের জমানো প্রায় চার লাখ টাকা শিবপুরের পাশের বারৈচা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের মসজিদে দান করি।

মাস দুয়েক আগে শরীরটা খুব খারাপ করে। আমার বাড়ি ফেরার ইচ্ছার কথা আশপাশের কয়েকজনকে বলি। তারা ঠিকানা চায়; কিন্তু আমি তো থানার নাম ছাড়া কিছুই মনে করতে পারি নাই। একটা ছেলে তখন ফেসবুক আমার ছবি দেয়। কিছুদিন পর কয়েকজনকে নিয়ে আমার সন্ধানে আসে ভাতিজা। তারা আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে।

বাড়িতে সবার সঙ্গে দেখা হয়ে অনেক ভালো লাগছে। অনেকে মারা গেছেন দেখে আফসোস লাগছে। আমি বাড়ি ছাড়ার সাত বছর পর মা মারা যান। স্ত্রীরও অন্য জায়গায় সংসার হয়েছে। এখন খাই না খাই, বাকি জীবনটা ভাই-ভাতিজাদের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে চাই।