চার হাজার মৃত নারী-পুরুষের দেহে ছুরি চালিয়েছেন তিনি
১৯৯১ সালে বাবার হাত ধরে লাশকাটা ঘরে ঢোকেন রামপ্রসাদ ডোম। শুরুতে ছিলেন সহকারী। চার বছর পর বাবা অবসরে গেলে মূল দায়িত্ব নেন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মর্গে সেই থেকে কাজ করে আসছেন। এবার রামপ্রসাদের উত্তরসূরি হতে চলেছেন তাঁর ছোট ছেলে রাজকুমার ডোম। ৫৫ বছর বয়সী রামপ্রসাদের কাছে ব্যতিক্রমী এই পেশার নানা গল্প শুনলেন শাহ আলম
অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ জানতে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তের কাজে মর্গ সহকারী বা ডোমের বড় ভূমিকা থাকে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে সেই দায়িত্বই পালন করছেন রামপ্রসাদ ডোম। এই পেশার কারণে সমাজের অনেকেই রামপ্রসাদকে বাঁকা চোখে দেখেন। কেউ কেউ তির্যক মন্তব্যও করেন। তারপরও কাজটি করে চলেছেন রামপ্রসাদ, ‘নিন্দুকে যা বলে বলুক। আমার দাদার থেকে বাবা, বাবার থেকে আমি এই পেশায় এসেছি। আমি চাই, আমার ছেলে এবং তাদের সন্তানেরাও এভাবে এই পেশায় থাকুক।’
তাই তো রামপ্রসাদ তাঁর ১৮ বছর বয়সী ছেলে রাজকুমার ডোমকে উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে তুলছেন। দেড় বছর ধরে বাবার কাছ থেকে কাজ শিখছেন রাজকুমার।
সাধারণত চিকিৎসকের পরামর্শ ও চাহিদা অনুযায়ী ময়নাতদন্তের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই কাটাছেঁড়া করেন রামপ্রসাদরা। পেশাগত কাজ হলেও মর্গে প্রিয় মানুষকে পাঠানো স্বজনদের কান্নাভেজা চোখ রামপ্রসাদকে অনেক সময় কষ্ট দেয়। সেই কষ্টের কাজে ৩২ বছরে নবজাতক থেকে শতবর্ষী প্রায় ৪ হাজার মৃত নারী-পুরুষের দেহে ছুরি চালিয়েছেন তিনি।
বাবার কাছ থেকে কাজ শেখার সময় সবকিছু স্বাভাবিক মনে হতো। তবে তাঁর বাবা মতিলাল যখন অবসরে গেলেন, তখন একা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিচিত্র ঘটনার মুখোমুখি হতেন। শুরুর দিকে প্রায়ই তাঁর মনে হতো, ছুরি চালানোর আগে মৃত ব্যক্তিটি যেন কী বলতে চাচ্ছেন! রামপ্রসাদ বলেন, প্রথম দিন লাশ কেটে মর্গ থেকে বের হচ্ছি, মনে হলো যেন রক্তাক্ত মৃতদেহটি পেছন পেছন উঠে আসছে এবং আমার কাঁধে হাত দিয়ে পেছন থেকে ডাকছে। আরেক দিন বাড়িতে ফিরে রাতে একা ভাত খেতে বসেছি, মনে হলো, ওই দিন কাটা মৃতদেহটি রক্তাক্ত শরীরে আমার পাশে বসে আমারই থালা থেকে ভাত খেয়ে চলেছে। স্বপ্নেও অনেক দিন অনেক মৃতদেহ দেখে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেছে। তবে এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মনের কোণ থেকে ভয় কেটে গেছে। সব কথার বড় কথা, এই পেশার মানুষদের সাহস ও ধৈর্য থাকতে হয়, ঘৃণা থাকা চলে না।
৩২ বছরের পেশাগত জীবনে ২০১৭ সালের ২৬ মার্চ এক দিনে সর্বোচ্চ ১৩টি মৃতদেহ কাটেন রামপ্রসাদ। ওই দিন জেলার দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুরে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে আলমসাধুর যাত্রী ১৩ শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। এ ছাড়া ১৯৯২ সালে আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সীগঞ্জ পশুর হাটে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত ১০ জনের মৃতদেহ কাটতে হয়েছিল রামপ্রসাদকে।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার কোর্টপাড়ায় পরিবার নিয়ে রামপ্রসাদের বসবাস। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে কাঠ ও সবজির ব্যবসা করে আর ছোটটাকে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে তুলছেন।