পুরস্কার না পাওয়ার কষ্টে হয়েছেন ক্রীড়াবিদ, তাঁর ঝুলিতে এখন আটটি জাতীয় স্বর্ণপদক
বর্শা নিক্ষেপ করে ঝুলিতে ভরেছেন জাতীয় পর্যায়ের আটটি স্বর্ণপদক। সাফ গেমসে করেছেন দেশের প্রতিনিধিত্ব। এখন প্রশিক্ষক হিসেবে জেলায় জেলায় তাঁর ডাক পড়ে। অথচ কৌতূহলবশতই হাতে তুলে নিয়েছিলেন বর্শা। কালীগঞ্জের কবিরুল ইসলামের ক্রীড়াবিদ হওয়ার সেই চমকপ্রদ গল্পই শুনেছেন আজাদ রহমান
তিন দশক আগের কথা। এসএসসি পাস করে ঝিনাইদহের সরকারি মাহাতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছেন কবিরুল ইসলাম। কালীগঞ্জের বেজপাড়ার বাড়ি থেকে নিয়মিত ক্লাস করেন। একদিন কলেজে গিয়ে দেখেন, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে। একসময় শুরু হয় বর্শা নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা। অনেককে বর্শা ছুড়ে মারতে দেখে কবিরুলের মনে হয়, এ তো সহজ খেলা! তিনি ছুড়লে বরং অনেকের চেয়ে ভালো করবেন। ক্রীড়া শিক্ষক আবদুর রহমানের কাছে গিয়ে অনুরোধ করলেন, তাঁকে একটি সুযোগ দেওয়া হোক। ছাত্রের আগ্রহ দেখে রাজি হয়ে গেলেন শিক্ষক।
জীবনে প্রথমবারের মতো হাতে বর্শা তুলে নিলেন কবিরুল। শক্ত করে ধরে ছুড়ে মারেন। শাঁই শাঁই করে সেটি চলে যায় অনেকটা দূরে, অনেকের চেয়ে দূরে। চারপাশ থেকে করতালি দিয়ে ওঠেন দর্শক। সবার বর্শা ছোড়া শেষে দেখা গেল, সবার সেরা হয়েছেন কবিরুল। প্রথমবার সুযোগ পেয়েই প্রথম হয়ে আনন্দ যেন তাঁর আর ধরে না।
তবে কবিরুলের মন খারাপ হয়ে গেল পুরস্কার বিতরণীর সময়। দেরিতে নাম লেখানোর কারণে তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হয় না। কষ্ট নিয়ে সেদিন কলেজ প্রাঙ্গণ ছেড়েছিলেন কবিরুল। তবে কষ্ট পেলেও ভেতরে-ভেতরে একধরনের ভালো লাগাও কাজ করছিল। তাঁর মনে হতে থাকে, এই খেলায় তিনি ভালো করতে পারবেন। যেমনটি কবিরুল বলছিলেন, ‘এই কষ্ট আমার ভেতরে একধরনের জেদ তৈরি করে। সিদ্ধান্ত নিই, যে করে হোক পুরস্কার ঘরে আনতে হবে।’
এরপর থেকে কলেজ শেষে বাড়ি ফিরেই গ্রামের বেজপাড়ার স্কুলমাঠে ছুটে যেতেন কবিরুল। বর্শা হাতে শুরু করতেন অনুশীলন। একা একাই আয়ত্ত করতে থাকেন বর্শা নিক্ষেপের বিভিন্ন কৌশল। অনুশীলন করতে করতেই যশোর শিক্ষা বোর্ডের আয়োজনে আন্তকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ঘোষণা আসে। নাম লেখান কবিরুল। তারপর একদিন চলে যান যশোরের নওয়াপাড়া সরকারি কলেজ মাঠে। সেই বছর এই মাঠেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসর বসেছিল। বর্শা নিক্ষেপ করে তিনি প্রথম হন। পরের বছরও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হন কবিরুল।
দেয়ালে সাঁটা পত্রিকায় হঠাৎ...
কলেজ পর্যায়ে পুরস্কার জিতলেও অ্যাথলেটিকস সম্পর্কে খুব একটা ধারণা কবিরুলের ছিল না। ভাবতেন, বর্শা নিক্ষেপ করে শুধু নামই কামানো যায়। এই খেলার মাধ্যমেও যে ভালো কিছু করা সম্ভব, অলিম্পিকেও যাওয়া সম্ভব, সেটি তিনি জানতেন না। কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘সব সময় ভালো খেলোয়াড় হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অ্যাথলেটিকস সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল না। তাই একসময় বর্শা নিক্ষেপের চর্চা বাদ দিয়ে ফুটবলে মনোযোগী হই।’
তত দিনে এইচএসসি পাস করেছেন কবিরুল। ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নে বিভোর তিনি। ঢাকার মাঠে খেলতেও শুরু করেছেন। ১৯৯৬ সালে ঢাকার এলাকাভিত্তিক একটি ক্লাবের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে পাইওনিয়ার কাপ ফুটবল লিগে অংশ নেন। টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার আগেই ডান পায়ে আঘাত পেয়ে মাঠ থেকে ছিটকে পড়েন। ফিরে যান বাড়িতে। বাধ্য হয়ে মন দেন সংসারে।
কিন্তু খেলা যাঁর রক্তে মিশে গেছে, তিনি কি আর ঘরে থাকতে পারেন। স্নাতকে পড়াশোনা আর সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন তিনি। ক্রিকেটে ভালো করতে পারবেন—এমন আশা নিয়ে ১৯৯৯ সালে আবার ঢাকায় চলে যান।
মগবাজার এলাকার একটি মাঠে শুরু করেন অনুশীলন। কিন্তু ভালো কিছু করতে পারছিলেন না। একবার তাঁকে বল করতে বলা হয়, আবার অন্য সময় ব্যাট করতে দেওয়া হয়। তিনি বুঝে ফেলেন, বোলিং ও ব্যাটিং কিছুই আসলে হচ্ছে না। এর মধ্যেই একদিন প্রশিক্ষণ শেষে পথে হাঁটছিলেন। দেয়ালে সাঁটানো পত্রিকায় কবিরুলের দৃষ্টি আটকে যায়, ‘দেখি বর্শা নিক্ষেপ প্রতিযোগিতার বিজ্ঞপ্তি।’
সেটি ছিল বাংলাদেশ অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের ২৫তম জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা আয়োজনের বিজ্ঞপ্তি। ঝিনাইদহ জেলার হয়ে অংশগ্রহণের আবেদন করেন কবিরুল।
চ্যাম্পিয়ন কবিরুল
২৫তম জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ৫২ দশমিক ১৮ মিটার দূরে বর্শা ছুড়ে প্রথম বছরেই জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন কবিরুল। পরের বছর হন দ্বিতীয়। সে বছরই খেলোয়াড় কোটায় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনে (বিজেএমসি) তাঁর চাকরি হয়ে যায়। পদ অফিস সহকারী। এরপর খেলা আর চাকরিতেই মেতে থাকেন কবিরুল। ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত প্রতিবছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ২০০৭ সালে বিজেএমসির সাত খেলোয়াড়ের চাকরি চলে যায়, যার মধ্যে কবিরুলও ছিলেন। চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে যান। তবে খেলা বন্ধ থাকে না। ২০০৮ সালে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয়নি, ২০০৯ সালে আবারও প্রথম। ২০১০ সালে সাউথ এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়ে ষষ্ঠ হন কবিরুল। ২০১০ সালের পর আবারও খেলা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যান। এরপরও ২০১১ ও ২০১২ সালে জাতীয় পর্যায়ে খেলায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় হন। ২০১৪ সালের পর থেকে মাস্টার গেমসে অংশ নিচ্ছেন তিনি।
হতে চান ভালো প্রশিক্ষক
২০০৭ সাল থেকে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন কবিরুল। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে তাঁর প্রশিক্ষক জীবনের শুরু। ২০০৯ সাল থেকে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কোর্সে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে বগুড়া সেনানিবাসে ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষক। ২০২১ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে কিছুদিন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। বগুড়া থেকে আবার ডাক এসেছে।
কবিরুল ইসলামের বয়স এখন ৪৬ বছর। কালীগঞ্জের বেজপাড়া গ্রামে স্ত্রী ইয়াসমিন পারভিন আর দুই মেয়ে কানিজ ফারজানা ও কানিজ ফাতেমাকে নিয়ে তাঁর সংসার। বড় মেয়ে স্নাতকে পড়ছেন, ছোটজন চতুর্থ শ্রেণিতে। নিজেও খেলাধুলার মধ্যে পড়াশোনাটা চালিয়ে গেছেন। ১৯৯৭ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর আবার ২০১৪ সালে বিপিএড (ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন) পাস করেছেন। তাঁর আগ্রহ এখন দক্ষ প্রশিক্ষক হিসেবে নতুন অ্যাথলেট গড়ার।