উড়োযানের নকশা করে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন এই শিক্ষার্থীরা
হাতে–কলমে নয়, ‘খাতা-কলমে’ তৈরি করতে হবে এমন এক উড়োযান, যা দ্রুতগতিতে চলতে পারবে দীর্ঘক্ষণ—এই ছিল প্রতিযোগিতার বিষয়। আরও শর্ত ছিল। প্রতিকূল পরিবেশে দরকারি পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। পাইলটবিহীন এই যান নিয়ন্ত্রিত হবে ভূমি থেকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য ভার্টিক্যাল ফ্লাইট সোসাইটি আয়োজিত এমনই এক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে শ্রেষ্ঠ নবাগত দলের (স্নাতক) পুরস্কার জিতেছেন বাংলাদেশের তরুণেরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই দলটির নাম ‘এয়ারবোর্ন ফিনিকস’। অনলাইনভিত্তিক প্রতিযোগিতায় ৭টি দেশের ২০টি দল অংশ নিয়েছিল। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, দুই বিভাগে শিক্ষার্থীরা আবেদন করার সুযোগ পেয়েছেন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মের মধ্যে শেষ হয় আবেদনপ্রক্রিয়া ও প্রস্তাবিত নকশা জমা দেওয়ার কাজ। ফলাফল আসে ১২ সেপ্টেম্বর। দলের সদস্যরা হলেন আব্দুল্লাহ আল আজিজ (দলনেতা), মো. সামিউল্লাহ প্রধান (সহদলনেতা), মো. রিদওয়ান হাসান, নুসরাত বিনতে আলম, মো. আবির রহমান, সামিয়া ইসলাম, নিলয় চৌধুরী ও কাউসার মিয়া। সবাই অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা উড়োজাহাজ প্রকৌশল (মহাকাশ) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জিয়াদ বিন আব্দুল আউয়াল।
যে নকশার জন্য পুরস্কার
গত বছর তুরস্ক-সিরিয়াজুড়ে আঘাত হেনেছিল ভয়ংকর প্রাণঘাতী এক ভূমিকম্প। ওই সময় ঘটনাস্থলের বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতি মাথায় রেখেই হবু বিমান প্রকৌশলীদের আধুনিক উড়োযানের নকশা করতে বলা হয়েছিল। বিস্তারিত খুলে বললেন দলনেতা আব্দুল্লাহ আল আজিজ, ‘এমন একটি আকাশযানের নকশা করতে বলা হয়েছিল, যা জাহাজ থেকে তৎক্ষণাৎ উড়াল দেবে। মাত্র ১.২৫ ঘণ্টার মধ্যে পাড়ি দিতে পারবে ১৮৫ কিলোমিটার পথ। ৫০০ মিটার ওপর দিয়ে উড়ে টানা ১০ ঘণ্টা ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সক্ষমতা থাকাও নকশার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে—এমন শর্তও ছিল। সবকিছু মিলিয়ে প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য নকশায় প্রতিফলিত করতে পেরেছি বলেই দল পুরস্কার জিতেছে।’ নকশার মাধ্যমে এর বহুমাত্রিক অবয়ব, সামগ্রিক খরচ, প্রযুক্তিগত ব্যবহারের সব বিষয় বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করতে হয়েছে।
এয়ারবোর্ন ফিনিকস
হেলিকপ্টারের নকশা করতে গিয়ে ভাবতে হয়েছে অনেক কিছু। ঘাঁটতে হয়েছে বিমানসংক্রান্ত বৈশ্বিক নথির নতুন-পুরোনো নানা খুঁটিনাটি। সহদলনেতা মো. সামিউল্লাহ প্রধান শোনালেন একটি দল হয়ে কাজ করার গল্প। তাঁর বক্তব্য, ‘যখন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, তখনো আমরা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ফলে উড়োজাহাজ প্রকৌশলের মূল কোর্সগুলো আমাদের করা হয়নি। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান না থাকলে কাজ এগিয়ে নেওয়া কঠিন। তাই নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এই প্রকল্পসংশ্লিষ্ট তৃতীয় বর্ষের পড়াশোনা সময়ের আগেই শিখেছি। সবাই এক হয়ে কাজ করার ফলে সহজ হয়েছে। যেহেতু এটি একটি প্রস্তাবিত তাত্ত্বিক নকশা, তাই এর সক্ষমতা নিয়ে অনেকভাবে কাজ করার সুযোগ আছে। তবে আমাদের হেলিকপ্টারের মূল বৈশিষ্ট্য হলো হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল, ডিম্বাকৃতির কাঠামো এবং কোএক্সিয়াল রোটর।’
পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন ফুয়েল জ্বালানি খরচ কমাতে সাহায্য করবে। ডিম্বাকৃতির কাঠামো ও কোএক্সিয়াল রোটর হেলিকপ্টারের অ্যারো ডায়নামিক নিয়ন্ত্রণ ও কম শক্তি ব্যয়ে সাহায্য করবে। প্রপেলারের ব্যবহার গতি বাড়িয়ে তুলবে। সব বৈশিষ্ট্যের সামগ্রিক প্রয়োগ তাঁদের নকশায় নতুনত্ব এনেছে বলে জানালেন এই শিক্ষার্থী।
তাত্ত্বিক নকশার প্রতিযোগিতা হলেও প্রকল্পটি নিয়ে যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখেন আব্দুল্লাহ আল আজিজ। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবিত নকশার বাণিজ্যিক সফলতা পাওয়ার সুযোগ আছে। ভবিষ্যতে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ইচ্ছাও আছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে এমন একটি হেলিকপ্টার বানানোর যে খরচ ধরা হয়, সেটি বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রারম্ভিক খরচ কিন্তু কম নয়। তাই পর্যাপ্ত বিনিয়োগ পেলেই আমরা কাজ শুরু করতে পারব।’