আর্জেন্টিনার দূতাবাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেন আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ফেনীর মতিন
৪৫ বছর পর আবার বাংলাদেশে চালু হলো আর্জেন্টিনার দূতাবাস। উদ্বোধনী আয়োজনে আর্জেন্টিনা সরকারের আমন্ত্রণে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এসেছিলেন ফেনীর আবদুল মতিন। তাঁকে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের একটি জার্সি উপহার দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়ারো। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে তাঁর মতো সাধারণ একজন মানুষকে কেন আমন্ত্রণ জানানো হলো? মতিনের কাছে সেই গল্পই শুনলেন কবীর হোসাইন
আবদুল মতিনের কথায় নোয়াখালীর আঞ্চলিক টান। কথাও বলেন দ্রুতলয়ে। কিন্তু তাতে তাঁর আবেগমেশানো বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মেইলটা পেলাম। দুর্ঘটনার পর থেকে আর্জেন্টিনার অনেক নাগরিক আমার খোঁজ–খবর নিয়েছেন। কিন্তু সরকারিভাবে এবারই প্রথম। এত ভালো লাগছিল, কী বলব!’ (সবার বোঝার সুবিধার্থে তাঁর সব কথা আমরা প্রমিত বাংলায় উদ্ধৃত করছি)
ফেনীর দাগনভূঞার তরুণ মতিন আর্জেন্টিনার দূতাবাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে ঢাকায় এসেছিলেন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাওয়া এবং সেখানে সবার উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া মতিন আনন্দে খলবল করছিলেন রীতিমতো। মুঠোফোনের ও প্রান্ত থেকে সেই গল্পই শোনাচ্ছিলেন মতিন। আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়ারো যখন তাঁকে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের মূল জার্সি উপহার দিচ্ছিলেন, আনন্দে তাঁর চোখে প্রায় পানি চলে আসছিল। সত্যিই তো, এই দলের জন্য কত বড় ত্যাগই না তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে! কী ভয়ানক ঝড়ই না বয়ে গেছে তাঁর জীবনে! পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা দিয়েছেন, মেসির সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন। বিশ্বকাপজয়ী পুরো দলটির সঙ্গেই দেখা করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মন্ত্রী।
মতিন জানান, আমন্ত্রণের মেইল পাওয়া থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে যোগদান—এই পুরো সময়ে দুটো বিষয় শুধু তাঁর মাথায় ঘুরেছে। একটি হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপ জয়ের পর ট্রফি হাতে আর্জেন্টিনা দলের ছবি। আরেকটি হচ্ছে ৯ বছর আগের সেই ভয়ংকর সকাল, যে সকাল তাঁর পুরো জীবনের প্রতিটি দিনকে এলোমেলো করে দিয়েছে!
কী হয়েছিল সেই সকালে
২০১৪ সাল। ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হতে তখনো ১৫-২০ দিন বাকি। তাতে কী, গ্রামে-গঞ্জে-শহরে প্রিয় দলের পতাকা টাঙানো শুরু হয়ে গেছে। আবদুল মতিনের প্রিয় দল আর্জেন্টিনা। মেসিদের জন্য তাঁর পাগলামোর শেষ নেই। সদ্য কৈশোর পেরোনো মতিন আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশ দুই দেশের পতাকাই কিনেছেন। দাগনভূঞায় তাঁর ছোটখাটো ব্যবসা। লেপ-তোশক-সোফা-পর্দা বিক্রির দোকান। তিনিই কারিগর। দোকানের তিনতলা ছাদের ওপর পতাকা টাঙাবেন।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টার মতো বাজে। পর্দা টানানোর স্টিলের পাইপের একদম ওপরে বাঁধলেন বাংলাদেশের পতাকা, এরপর আর্জেন্টিনার পতাকা। ছাদের পাশ দিয়ে চলে গেছে শহরের মূল বিদ্যুৎ লাইন। মতিনের কাছ থেকে মাত্র দুই–তিন হাত দূরে সেই লাইন। ছাদে জমে ছিল বৃষ্টির পানি। এসবের কিছুই অতটা খেয়াল করেননি মতিন। হাতে ধরে রাখা স্টিলের পাইপ গিয়ে লাগে লাইনে। তারপর? তারপরের আর কিছুই তার মনে নেই। ফোনের ও প্রান্তে তাঁর দুঃস্বপ্নতাড়িত গলা শোনা যায়। একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর আবার বলতে শুরু করেন। তখন সঙ্গে ছিল আশিক নামের একটি ছেলে। নিচের এক দোকান থেকে ইউনুস নামের আরেকজন দুর্ঘটনাটি দেখেছিলেন। তাঁরাই সেখান থেকে তাঁকে নামিয়ে আনেন। বাড়ির লোকজন, এলাকার শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই মিলে এরপর হাসপাতালে নিয়ে যান। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে দ্রুতই পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। সেখানে চিকিৎসা চলে। কেটে ফেলতে হয় দুই হাত, দুই পা। দীর্ঘ তিন মাসের চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে আসেন হাত-পাবিহীন মতিন।
বেঁচে থাকার যুদ্ধ
হাত-পা হারিয়ে একেবারে কর্মশক্তিহীন হয়ে পড়েন মতিন। তত দিনে চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে দোকানসহ যা কিছু ছিল, সবই ধীরে ধীরে বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁর বাবা। যে হাত দিয়ে লেপ-তোশক সেলাই করতেন, নিষ্পলক সেই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া মতিনের কিছু করার থাকে না। এখন কীভাবে চলবে সংসার! এমন অবস্থায় এগিয়ে আসেন আত্মীয়স্বজন, এলাকার মানুষ।
কিছুদিন আগে মতিনের বাবাও মারা গেছেন। সংসারে মা, স্ত্রী ও বছর সাতেকের একটা মেয়ে আছে। এখনো এলাকার মানুষগুলোই আগলে রেখেছেন। তাঁদের প্রতি মতিনের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা তাঁর কথা বলার ভঙ্গিতেই টের পাওয়া যায়।
ফোনালাপের একফাঁকে আরেকজনের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। বিবি ফাতেমা—তাঁর তৎকালীন প্রেমিকা, বর্তমান স্ত্রী। দুর্ঘটনার আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে প্রেম ছিল। দুর্ঘটনার পরও সরে দাঁড়াননি, কেবল তাঁর শুশ্রূষা করবেন বলে পুরো প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশ উপেক্ষা করে বিয়ে করেছিলেন মতিনকে। তাও দুর্ঘটনার ছয়-সাত মাসের মাথায়!
ভক্ত হোন, অন্ধ নয়
মতিন বারবার বলছিলেন, আর্জেন্টিনা দেশটা সম্পর্কে তাঁর সে রকম কোনো ধারণা নেই। কেবল ফুটবল খেলাটাকে ভালোবেসেছেন, দলটাকে ভালোবেসেছেন। এই ভালোবাসার জন্য যে ভয়ংকর ক্ষতি তাঁর হয়ে গেছে, এমন যেন আর কারও না হয়। তিনি বলেন, ফুটবল ভালোবাসুন। আনন্দ করুন। কিন্তু অন্ধের মতো নয়। বেপরোয়াভাবে নয়। তিনি চান, ঝগড়া নয়, মৃত্যু নয়, পঙ্গুত্ব নয়—কেবল নির্মল আনন্দের ব্যাপার হবে ফুটবল খেলা।