আমি আমার ছোট মাইয়ারে বিয়া দিব না
প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।
এক থালায় চারটি রুটি আর একটু ডাল ভাগ করে খেয়ে আমরা পাঁচজন মানুষ জীবন পার করেছি একসময়। নুন আনতে পান্তা ফুরায়—এমন পরিবেশে ছোটবেলা থেকে আমার পড়াশোনা করার শখ। প্রতিদিন বায়না ধরতাম, স্কুলে যাব।
একদিন মা বললেন, যা, স্কুলে ভর্তি হয়ে আয়।
একাই চলে গিয়েছিলাম। তারপর থেকে একা একাই স্কুলে যাওয়া-আসা করতাম।
২০১৬ সাল। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। মগবাজারে একটি বাসার নিচতলায় ভাড়া থাকি আমরা। ভাইয়া বেকার, মায়ের একার উপার্জনে সংসার চলছে। আমি তখন সদ্য কিশোরী। দুই বেণি দুলিয়ে স্কুলে যাই। হঠাৎ বাসায় বিয়ের কথাবার্তা উঠল। মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করতে নেই, এই তত্ত্বে ভর করে আমার পাত্র খোঁজা হচ্ছে। নিত্যনতুন সম্বন্ধ আসছে। সে পাড়ারই এক বাড়িওয়ালার ছেলের আমাকে মনে ধরেছে! অভাব-অনটনের পরিবারে এমন সম্বন্ধ লটারি জেতার মতো। তাই ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন সবাই এক পায়ে রাজি।
আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো। ঘরের এক কোণে পড়ে থাকি।
এক সন্ধ্যায় আর পারলাম না, সবার সামনে মাকে গিয়ে বললাম, আমি বিয়ে করব না। আমি আরও পড়াশোনা করতে চাই, বড় হতে চাই।
ঘরের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। বড়রা সবাই খেপে গেল। মা হঠাৎ রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন, বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি আমার ছোট মাইয়ারে বিয়া দিব না। ও পড়াশোনা করুক।’ তারপর একনাগাড়ে বলে গেলেন, ‘অর্থকষ্টে আমার কোনো পোলাপানই লেখাপড়া করতে পারে নাই, ও পড়ব। কাউরে আমার মাইয়ার জন্য কোনো চিন্তা করা লাগব না। ওর বই, খাতা, কলম, জামা, জুতা যা লাগে, সব আমি বুঝুম। ও আগের মতো স্কুলে যাইব। পড়াশোনায় ভালো, ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট হয়, ওর পড়ালেখা করণের দরকার আছে।’
কেউ আর সেদিন মায়ের ওপর কোনো কথা বলার সাহস পেল না। আমি আরও শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। পাথরের মতো মা আমাকে জড়িয়ে ধরে রইলেন।
এক সন্ধ্যায় আর পারলাম না, সবার সামনে মাকে গিয়ে বললাম, আমি বিয়ে করব না। আমি আরও পড়াশোনা করতে চাই, বড় হতে চাই।
সেই থেকে পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন মা। আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা আমাদের মতো পরিবারের জন্য যুদ্ধসম। আমার সমবয়সী কারও বিয়ে হলেই মাকে খোঁচা শুনতে হতো। তবুও প্রত্যেকটি মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে মা আমার পাশে থাকেন। আমি প্রতিটি ক্লাস পার হয়ে নতুন ক্লাসে উঠি আর জিতে যান আমার মা।
এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ছি। গল্প-উপন্যাসে অনেক মায়ের গল্প পড়েছি। কিন্তু সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়তে গিয়ে আমি ‘মা’কে আবিষ্কার করলাম—ধৈর্য–সহ্যে নিপুণা, লড়াকু এক সৈনিক দীপাবলি। জীবনযুদ্ধে হার না মানা যোদ্ধা। একাই যিনি যুদ্ধ করে মরতে রাজি; কিন্তু এতটুকু আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিতে নারাজ। আমার মা, স্বাক্ষর ছাড়া অক্ষরজ্ঞানটুকু যার নেই। তারপরও তিনি স্বাধীন, স্বনির্ভর এবং প্রবল আত্মমর্যাদাশীল একজন নারী।