নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, এখন বিসিএস ক্যাডার
গল্প-আড্ডায় বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটা উপভোগের সুযোগ আবদুল মোত্তালিবের হয়নি। দুপুর গড়ালেই তাঁকে ছুটতে হতো কাজে। অসচ্ছলতার কারণে স্নাতকের তৃতীয় বর্ষেও নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করেছেন এই তরুণ। টিউশনি করেছেন, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়েছেন। এত কষ্ট সার্থক হয়েছে। ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন তিনি।
পড়ালেখার ঝোঁকটা কীভাবে তৈরি হলো? আবদুল মোত্তালিব বলছিলেন, ‘কৃষিকাজ করলেও বাবার নিজের কোনো জমি ছিল না। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন। বাড়ি বলতে আমাদের ছিল একটা মাত্র ঘর। সেই ঘরে বোন থাকত, আর বারান্দায় মা-বাবা। আমার জায়গা হয়েছিল ছোট চাচার ঘরে। দরিদ্র পরিবারে মা-বাবাকে সাহায্য করে পড়ালেখা চালিয়েছি। যখন মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে গেলাম, তখন পরিবার আর এলাকার লোকজনের আগ্রহেই ভর্তি হই বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে।’
নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজের শুরু
উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক শাখা থেকে ভালো ফল করেও প্রথমবার শুধু টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি আবদুল মোত্তালিব। বগুড়ায় যে মেসে থাকতেন, টাকা দিতে না পারায় সেখানেও ‘মিল’ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অগত্যা গ্রামে ফিরে যান তিনি।
তারপর? ‘গ্রামের এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, সে ঢাকায় একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। সেই বন্ধুকে ধরে ঢাকায় আসি, নিয়োগ পাই নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে। তখন লক্ষ্য ছিল শুধু কিছু টাকা উপার্জন করে পরিবারে সচ্ছলতা আনব। এরই মধ্যে আরেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা, বগুড়ার মেসে আমরা একসঙ্গে থাকতাম। শুনলাম সে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন আমিও চাকরির পাশাপাশি ভর্তির প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।’
একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও আবদুল মোত্তালিব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিয়েছিলেন; কারণ, তাঁর ‘ডিউটি’ ছিল ধানমন্ডিতে। সেখান থেকে জগন্নাথে যাওয়া-আসাটা তুলনামূলক সহজ। আবদুল মোত্তালিব বলেন, ‘বাড়তি টাকার জন্য ডাবল শিফটে কাজ শেষে ক্যাম্পাসের বাসে চড়েই প্রতিদিন ক্লাসে যেতাম। আবার দুপুর ১২টা বাজলেই ক্লাস-পরীক্ষা থাকলেও কর্মক্ষেত্রে চলে যেতে হতো। আমি যেহেতু এটিএম বুথে দায়িত্ব পালন করতাম, মাঝেমধ্যে পরিচিত কারও না কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। তখন আসলে একটু সংকোচই হতো। আমি কোম্পানিকে অনুরোধ করেছিলাম, আমাকে যেন গেটের ভেতরে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গেটের বাইরে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে চাইতাম না। অনেক সময় কোম্পানি আমার কথা রেখেছে। তবে সব সময় সাহায্য করার সুযোগ তাদেরও ছিল না।’
চলার পথে কত মানুষের সহযোগিতা পেয়েছেন, তা-ও আবদুল মোত্তালিব স্মরণ করলেন কৃতজ্ঞচিত্তে। বলছিলেন, ‘সৈয়দ শোভন নামের এক বন্ধু একবার আমাকে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতে দেখে ফেলেছিল। পরে দেখা করার অজুহাতে মাঝেমধ্যে আমার জন্য সে খাবার নিয়ে আসত। গল্প-আড্ডায় আমাকে অনুপ্রেরণা দিত।’
আরও নানা কাজ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে পড়তেন আবদুল মোত্তালিব। টিউশনি পাওয়াটা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। তাই তিনি খুঁজছিলেন কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ। যখন নিরাপত্তারক্ষীর ডিউটি কম থাকত, তখন একটা কোচিংয়ে পড়াতেন তিনি।
নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি তাঁকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত করতে হয়েছে। পরে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সাধারণ জ্ঞানের বই লেখার কাজও করেছেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকেই চালিয়ে গেছেন বিসিএসের প্রস্তুতি। আবদুল মোত্তালিব বুঝতে পেরেছিলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করলে লোকে কিছুটা মূল্যায়ন করেন। কিন্তু স্নাতকের পর সামাজিক অবস্থান পেতে হলে একটা ভালো চাকরি লাগবেই। তাই জোর প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন সুফল।
আবদুল মোত্তালিব বলেন, ‘চায়ের সঙ্গে রুটি-কলা বা কেক খাওয়াও আমার জন্য বিলাসিতা ছিল। ভালো কিছু খেতে হলে দুই-তিন দিনের টাকা খরচ হয়ে যেত। এখন যখন সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁদের কিছু ভালো খাবার কিনে দিতে চেষ্টা করি। কারণ, তাঁদের অবস্থা আমি বুঝি। ভবিষ্যতে সরকারের যে দায়িত্বেই থাকি না কেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করার চেষ্টা করব।’