কিছু মানুষ কেন সব সময়ই দেরি করে
একটু ভাবুন তো, কোনো অ্যাসাইনমেন্ট করতে আপনাকে এক মাস সময় দেওয়া হলেও আপনি কেন সেটা ডেডলাইনের ঠিক দুই-তিন দিন আগে করতে বসেন? অথবা অফিসের কোনো দলগত কাজ করতে গেলে এমন একজন না একজনকে পাওয়া যাবেই, যিনি নিজের কাজটুকু শেষ মুহূর্তে শুরু করবেন। পুরো দলকেই যার ফল ভোগ করতে হবে। কিংবা স্মরণ করুন আপনার সেই বন্ধুকে, যে নির্ধারিত সময়ে কখনোই কোথাও হাজির থাকতে পারে না। ৩০ মিনিটের দূরত্ব যে ৫ মিনিটে অতিক্রমের আশা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়! মানুষের এই দেরি করার প্রবণতার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ, যেমন ব্যক্তিত্ব, সময় ও স্থান সম্পর্কে ব্যক্তির নিজস্ব ধারণা কিংবা সময় ব্যবস্থাপনা। বিশেষজ্ঞরা মানুষের এই নেতিবাচক স্বভাবকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, চলুন সেটাই জেনে নেওয়া যাক।
গোলমেলে দেহঘড়ি
বিশেষজ্ঞরা কিছু মানুষের সব সময় দেরি করার স্বভাবটির জন্য আমাদের মস্তিষ্কের বিশেষ প্রক্রিয়াকে দায়ী করে থাকেন। এমন একজন বিশেষজ্ঞ হলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক হুগো স্পিয়ার্স। তিনি তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেন, মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস নামক অঞ্চল মানুষের সময়বোধ তথা কোনো কাজ কখন এবং কতটুকু সময়ে করা যায়, সে ধারণা প্রক্রিয়াকরণে ভূমিকা রাখে। তাঁর এই বক্তব্যকে সমর্থন করে ‘নেচার রিভিউজ নিউরোসায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাকর্মে দাবি করা হয়, হিপোক্যাম্পাস অঞ্চলে যে নিউরনগুলো থাকে, তা মূলত ‘টাইম সেল’ হিসেবে কাজ করে। এই সেল আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা মনে রাখতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের এই বিশেষ প্রক্রিয়া কোনো কারণে সঠিকভাবে কাজ না করলে ব্যক্তির সময়জ্ঞানে অসংগতি দেখা দিতে পারে।
স্নায়বিক রোগ এডিএইচডির (মনোযোগের ঘাটতিবিষয়ক ব্যাধি) ফলেও ব্যক্তি সময়জ্ঞান সম্পর্কে অসচেতন হয়ে পড়েন বলে দাবি করছে ‘মেডিকেল সায়েন্স মনিটর’ জার্নালে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনা। মূলত মনোযোগের ঘাটতি থেকে রোগী কোনো কাজ করতে কতটুকু সময় লাগে, তার কোনো স্বচ্ছ ধারণা রাখতে পারে না। ফলে নিজের অজান্তেই দেরি হয়ে যায়।
স্থান, দূরত্ব নির্ণয়ে আপেক্ষিকতা
অচেনা কোনো জায়গায় যেতে হলে কি আপনি হাতে অতিরিক্ত সময় নিয়ে বের হন? চেনা জায়গায় যাওয়ার ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনা ঘটে? সচরাচর এমনটা হয় না। অচেনা জায়গায় নির্দিষ্ট স্থান খুঁজে বের করতে সময় লাগতে পারে, তাই নির্ধারিত সময়ের আগেই আপনি পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তাই এ রকম পরিস্থিতিতে ব্যক্তির দেরি করার আশঙ্কা কম। কিন্তু চেনা জায়গায় পৌঁছাতেও আমরা অনেক সময় দেরি করে ফেলি। কেন এমনটা ঘটে? ফিরে যাই হুগো স্পিকারের গবেষণায়। স্পিয়ার্স লন্ডন শহরে নবাগত ২০ জনকে তাদের কলেজ এলাকার একটি ম্যাপ এঁকে সেখান থেকে বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার সময় নির্ণয় করতে বলেছিলেন। দেখা যায়, তুলনামূলক পরিচিত স্থানে যাতায়াতের জন্য অংশগ্রহণকারীরা কম সময় নির্ধারণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে দূরত্ব যা-ই হোক না কেন, স্থান যত অপরিচিত, ব্যক্তি সেখানে পৌঁছানোর জন্য তত বেশি সময় নির্ধারণ করে থাকেন। তাই অনেকে পরিচিত স্থানে যাতায়াতে সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে দায়সারা ভাব দেখান।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস
আত্মবিশ্বাসী মানুষ সর্বক্ষেত্রে প্রশংসনীয়। কিন্তু যাঁরা দেরি করেন, তাঁদের এই আত্মবিশ্বাস মাঝেমধ্যে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। নিত্য যেসব কাজ করা লাগে, তা আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই করি, সময় অনুমানও সে অনুযায়ী করা হয়। কিন্তু যাঁরা নিত্যদিনের কাজেও দেরি করেন, তাঁরা মূলত অনুমানে ভুল করেন। নিজের অনুমানও যে ভুল হতে পারে, তা তাঁরা কখনো আমলে নেন না। ‘মেমোরি অ্যান্ড কগনিশন’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাকর্ম থেকে জানা যায়, আমরা অতীতে যে কাজগুলো করতে যতটা সময় নিয়েছিলাম, সে ধারণাই আমাদের পরবর্তী সময়ে কাজটি আবার করতে কত সময় লাগবে তা নির্ধারণ করে দেয়; কিন্তু আমাদের স্মৃতি ও উপলব্ধি সব সময় সঠিক না।
সময়বিভ্রান্তি
২০২২ সালে ‘ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সিমুলেটেড পাতালরেল ভ্রমণের দূরত্ব অনুমান করতে বলা হয়েছিল। তাঁরা দুই ধরনের ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। প্রথমটিতে যাত্রীর সংখ্যা ছিল কম, আর দ্বিতীয়টি ছিল জনাকীর্ণ। দেখা গেছে, যে ভ্রমণপথটি জনাকীর্ণ ছিল তার দূরত্ব কম জনবহুল রাইডটির চেয়ে ১০ ভাগ বেশি মনে হয়েছে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে। অর্থাৎ অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হলে ব্যক্তির কাছে সময়কে মনে হয় ধীর, ফলে অনুমানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
সব কাজের কাজি কিন্তু…
একই সময়ে বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকাকে মাল্টিটাস্কিং বলে। অনেকের ক্ষেত্রে একসঙ্গে অনেক কাজ করা দুধ-ভাত। কর্মক্ষেত্রে আপনার এই গুণ আপনাকে অন্যদের থেকে এগিয়েও রাখবে। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন আপনি সব দিক সামলাতে গিয়ে কোনো একটি কাজের ডেডলাইন মিস করে ফেলেন। ‘অ্যাডভান্সেস ইন কগনিটিভ সাইকোলজি’ জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা বলছে, যে ব্যক্তিরা একসঙ্গে অনেক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে অন্যান্য পরিকল্পিত কাজ মনে রাখা এবং সময়মতো সম্পন্ন করার সম্ভাবনা থাকে কম।
আজ না হলে কাল?
আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখাকে ইংরেজিতে একটি সুন্দর শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, ‘প্রোক্রাস্টিনেশন’! মানুষ এই স্বভাবের কারণে বেশির ভাগ সময় গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অপছন্দনীয় কাজকে আগামীর জন্য ফেলে রাখে। বিপরীতে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় ও পছন্দনীয় কাজ নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, ফলে দিন শেষে পড়তে হয় বিপদে। এই স্বেচ্ছাবিলম্বিতকরণকে যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফিউশিয়া সিরোইস কাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক দিয়ে যাচাই করেছেন। অর্থাৎ কোনো কাজ ব্যক্তির কঠিন মনে হলে সে তা সম্পন্ন করতে অধিক সময় নেয়। কিন্তু নিজের কাজ ফেলে রাখতে গিয়ে ব্যক্তি তার সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও বিড়ম্বনায় ফেলে দেয়। ফলে এর প্রভাব পড়ে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর।
সূত্র: লাইভসায়েন্স ডটকম