স্বপ্ন বাড়ি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’ শুরুতে ছিল গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল। পরে পূর্ণ গান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গানের গীতিকার রাসেল মাহমুদ লিখেছেন এই গানের পেছনের গল্প।
ছোটবেলায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতাম—কবে ঈদ আসবে, আর নানু-দাদুবাড়ি যাব। ঢাকা শহরে জন্ম, বেড়ে ওঠা; তবু গ্রামের বাড়ির যে আদর-মায়া-ঘ্রাণ-টান—সব মিলিয়ে এক ঘোর লাগা মোহ কাজ করত। আর মা-বাবাকে দেখতাম মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করতে! ঈদযাত্রার শত ঝক্কি ভুলে প্রতিবছর আমরা ছুটে যেতাম সেই স্বপ্নের টানে। স্বপ্নই তো! সপ্তাহখানেক কাটানো সেই শুদ্ধ শান্তির সময়টা স্বপ্নের মতোই মনে হতো। লাখো-কোটি মানুষ স্বপ্নের খোঁজে প্রিয়মুখ, চেনা উঠোন ছেড়ে ছুটে যায় শহরে, পাড়ি দেয় বিদেশ। একটা সময় ফেলে আসা সেই চেনা পথকেই মনে হয় স্বপ্নের মতো। বারবার ফিরে যেতে চায় চির আপন সেই স্বপ্নপুরে।
২০১৬ সাল। তখন আমি গ্রে অ্যাডভারটাইজিংয়ে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে চাকরি করি। গ্রামীণফোনের জন্য যখন বিজ্ঞাপন তৈরির সুযোগ হলো, মনে হলো ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ২০১০ সালে আনিকা মাহজাবিনের কথায়, হাবিব ওয়াহিদের সুরে, মিলন মাহমুদের গাওয়া ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সেই অনুভূতিকে নতুন করে আরও বড় পরিসরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাটা বাড়তি চাপ মনে হচ্ছিল। কিন্তু অদ্ভুত একটা জেদ; ফিরিয়ে আনতেই হবে। বুঝলাম, মাথা দিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই, যা করতে হবে মন থেকেই। খুব সহজ কথায় ছড়ার আদলে লাইনগুলো প্রথমে লিখে ফেললাম।
স্বপ্নটানে দিলাম পাড়ি
অচিন পথে, আপন ছাড়ি।
পেছন ফেলে উঠান-বাড়ি
প্রিয় মুখ আর স্মৃতির সারি।
মন বলে, চল ফিরে আবার
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।
আসছে সেদিন, বছর ঘুরে,
দিচ্ছেরে ডাক আপন সুরে।
যাচ্ছি আমার স্বপ্নপুরে
চেনা পথের বহু দূরে।
এইতো সময় ফিরে আসার
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।
হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে কয়েক দফা সুর নিয়ে বসা হলো। আমরা একজন নতুন শিল্পী খুঁজছিলাম, যার কণ্ঠে অতটা পরিপক্বতা নয়, বরং কাঁচা মাটির আবেগ পাওয়া যায়। বাদ্য অনুষঙ্গে থাকা মিঠুন চক্রকে একবার গাইতে বললেন হাবিব ভাই। শুনেই আমাদের মনে ধরে গেল।
এই গানের স্ক্রিপ্ট লেখার সময় অনেক চরিত্র নিয়ে আসতে চাইনি। মনে হলো, তাতে আবেগটা আধো আধো ঠেকবে। তিনটা সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করলাম আমরা। শহরে পড়তে আসা একটা মেয়ের সঙ্গে তার মা আর বোনের, সদ্য বিবাহিত এক যুবকের সঙ্গে গ্রামে অপেক্ষায় থাকা তাঁর স্ত্রীর আর শহর-গ্রামে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বন্ধুদের। পরিচালক শাহরিয়ার পলক তাঁর দল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দৃশ্য ধারণ করতে। পুরোটা সময় গ্রামীণফোনের তৎকালীন বিপণন প্রধান সোলায়মান (আলম) ভাই আর গ্রের প্রধান (সৈয়দ গাউসুল আলম) শাওন ভাই সাহস দিলেন। সঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড টিম তো ছিলই।
গানটা প্রকাশ পাওয়ার পর যা ঘটল, সেই আবেগ প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। সাত বছর পেরিয়েও গানটা এখনো প্রতিবছরের দুই ঈদের ‘অ্যানথেম’! কোটি কোটি মানুষ এখনো গানটা গেয়ে থাকেন, শোনেন, দেখেন, শেয়ার করেন, অনুভূতি জানান। প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি আবেগতাড়িত হন। আর তাঁদের দেখে আমিও বারবার আপ্লুত হয়ে যাই। গীতিকার বা স্ক্রিপ্ট রাইটারদের সাধারণত কেউ মনে রাখেন না, নামও উল্লেখ করেন না। করলেও অনেক সময় ভুল নাম দেওয়া হয়। একটু খারাপ লাগে মাঝেমধ্যে, কিন্তু এই গান যে সীমাহীন ভালোবাসা পেয়েছে, তাতেই মন ভরে যায়।
সবার ঈদযাত্রা শুভ হোক! ঈদ মোবারাক!